যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার মাউন্ডসভিলে ফোটা আমেরিকান কাশফুল
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার মাউন্ডসভিলে ফোটা আমেরিকান কাশফুল

আমেরিকান কাশফুল

এবার বাংলায় শরৎ যেন আসতে চাইছে না। যে শরতে শিশির পড়ে, নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভাসে, শিউলি ফোটে, কাশফুলের পশমি চাদরে ঢেকে যায় নদীর পাড়, শরতের সেই স্নিগ্ধ রূপ এখনো অভিমানী মেয়ের মতো মুখ লুকিয়ে আছে। বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ বৃষ্টির হানা, কোমল ধূসর মেঘের ওড়াউড়ি যেন শরৎকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তনে কি আমরা শরৎকেও হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছি? দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসার আগে সে রকম শরৎই দেখে এলাম, শিউলি না ফুটলেও কাশফুল ফুটেছিল আমিনবাজারের জলাভূমির ধারে, রাজহাঁসের পালকের মতো শুভ্র সেসব ফুল দেখতে গিয়ে তবু মন খারাপ হলো। কোমল ফুলগুলো যেন বর্ষাভেজা হয়ে কাঁদছে, ডানা মেলতে পারছে না, কাঠির মতো পুষ্পদণ্ডের আগায় ময়লা সাদা ভেজা ত্যানার মতো জবুথবু হয়ে রয়েছে। সেই মন খারাপ নিয়েই চলে এলাম যুক্তরাষ্ট্রে।

যুক্তরাষ্ট্রেও এখন চলছে শরৎ-হেমন্তকাল, আমেরিকানদের ভাষায় ফল সিজন বা অটাম। সেপ্টেম্বরের ২২ বা ২৩ তারিখে শুরু হয়ে ডিসেম্বরের ২১ বা ২২ পর্যন্ত চার মাস চলবে এই ঋতু। বাংলার শরৎ দুই মাস ও হেমন্ত দুই মাসের। শরৎকে ইংরেজিতে বলি অটাম, হেমন্তকে লেট অটাম। এ দুটি ঋতু মিলে অর্থাৎ চার মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্রে অটাম বা ফল সিজন। এ সময় ঠান্ডা পড়তে শুরু করে, বৃষ্টি কমে আসে। কিন্তু যে বৃষ্টিকে দেশে ছেড়ে এলাম, যুক্তরাষ্ট্রে এসেও সেই বৃষ্টির পাল্লায় পড়লাম। সপ্তাহখানেক হলো সূর্যের মুখ দেখিনি। পাহাড়ি শহর পিটসবার্গের পথ-জঙ্গল, গাছপালা সব বৃষ্টিতে ভেজা। জোরে বৃষ্টি না পড়লেও ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে মাঝেমধ্যেই, আর আকাশ ঢেকে আছে কালচে মেঘে।

অগত্যা ঘরে বসে না থেকে বেরিয়ে পড়লাম পেনসিলভানিয়ার পিটসবার্গ থেকে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার পাহাড়ি বনবিহারে। হোক বৃষ্টি, তবু দেখা তো হবে! রাস্তা-জনপদ, বনজঙ্গল, সবুজ তৃণভূমি, গ্রামের দোচালা ঘরবাড়ি—সব যেন ছবির মতো সাজানো। পাহাড় থেকে ঝিরি নেমে রাস্তার কোল দিয়ে বয়ে চলেছে। অল্প পানি, হেঁটেই পার হওয়া যায়। দেখতে দেখতে পথের দুই পাশে থাকা উঁচু-নিচু বন চিরে গাড়ি ছুটে চলেছে। শরতের রং লেগেছে এ দেশের প্রকৃতিতে। মেপলের সবুজ পাতাগুলো হলদে ও লাল হতে শুরু করেছে, পাইনের ডালগুলো হিমকুচি বরণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। তবে প্রকৃতিতে এখানে অটামের যে বর্ণিল ব্যঞ্জনা, তা দেখতে হলে আরও অপেক্ষা করতে হবে। কত গাছ, মাইলের পর মাইল কেবল গাছপালা, কোনো গাছই চিনি না। দেখতে দেখতে ঘণ্টা দেড়েক পর পৌঁছে গেলাম মাউন্ডসভিলে।

হঠাৎ একটি লেকের মতো জলাশয় দেখে মনটা আনন্দে ভরে উঠল। এবার আর অচেনা গাছ নয়, চেনা গাছ চোখের সামনে ঝিলের পাড়ে বাংলার চিরপরিচিত কাশফুল আর হোগলাপাতার ঝোপ। হোগলাপাতা ও কাশগাছে ফুল ফুটেছে। ঝিলকে ঘিরে চারপাশে ওপরে উঠে গেছে পাহাড়, সেসব ঢালে হলদে-সবুজ পাতাওয়ালা গাছগুলোর ছায়া পড়েছে ঝিলের স্থির জলে। বৃষ্টি নেই, রোদও নেই। পাহাড়ের ঠান্ডা বাতাস আছে। সে হাওয়ায় কাশগুচ্ছের মাথা দোলানো যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে এক টুকরা বাংলাদেশকেই, শরতের বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলার শরতের শুভ্রতা নেই আমেরিকান কাশফুলে। সেসব পুষ্পগুচ্ছের রং যেন পাটের আঁশের মতো ফিকে সোনালি। কিন্তু পাতা ও গাছ হুবহু বাংলার কাশফুল গাছের মতো।

ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার মাউন্ডসভিলে কাশবনের অংশবিশেষ

গুগল সাহেবের কাছ থেকে জানা গেল, ওই ঘাসের নাম চীনা সিলভার গ্রাস, উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Miscanthus sinensis, গোত্র পোয়েসি। তার মানে এ গাছ ধান-কাশগাছের সহোদর। বীরুৎ শ্রেণির এ গাছ বাঁচে কয়েক বছর, ১ থেকে ২ মিটার লম্বা হয়, যেখানে জন্মে সেখানে কাশগাছের মতোই ঝোপ করে ফেলে। পাতা ঘাসের মতো হলেও অনেক সরু ও লম্বা, সবুজ। পাতার চেয়ে ওপরে গুচ্ছাকারে প্রচুর ফুল ফোটে সরু কাঠির মতো দণ্ডে। মাউন্ডসভিলে থেকে ফেরার পথে রাস্তার দুই পাশে দেখলাম আরও অনেক গোছা ধরে ফোটা কাশফুল। পাশে অনেক বুনো ফুল, অজস্র গোল্ডেন রড ফুল ফুটে আছে থোকা ধরে, মাটির কাছাকাছি সাদা তারার মতো জ্বলছে বুনো ডেইজির ফুলগুলো। এমনকি শহরের মধ্যে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণেও দেখলাম এ গাছ। তাতে মনে হলো, বাংলার কাশফুল যতটা প্রাকৃতিক, আমেরিকান কাশফুল ঠিক ততটাই লালিত। আমেরিকানরা যত্নœ করে লাগায় এ গাছ। আমেরিকায় এ গাছ শোভাবর্ধক গাছ হিসেবে বিভিন্ন পথের পাশে ও বাগানে লাগানো হয়। আমরা বাংলার শোভাময়ী কাশফুলকে এখনো বাগানে ঠাঁই দিতে পারিনি।

  • মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক