তাপপ্রবাহে দেশে যে অসহনীয় অবস্থা বিরাজ করছে, এর জন্য সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তিগত লোভও অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)। সংগঠনটির পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, শুধু পুঁজিকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনাও পরিবেশের ক্ষতি করছে, বিপর্যয় ডেকে আনছে।
আজ মঙ্গলবার সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাপা বলেছে, উন্নয়ন প্রকল্প করার সময় পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি সরকার বিবেচনায় নিতে চায় না। গত কয়েক বছরে সরকার পরিবেশ সুরক্ষায় এমন কোনো কাজ করেনি, যার ফলে দূষণ কমতে পারে; বরং পরিবেশের ক্ষতি করে, পরিবেশবাদীদের পরামর্শ, মতামত ও সুপারিশ উপেক্ষা করে বিভিন্ন প্রকল্প নিয়েছে সরকার।
অন্যদিকে ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে সাধারণ মানুষও কোনো ফাঁকা জায়গা রাখছেন না বলে মনে করে বাপা। সংগঠনটি বলছে, শহরে–গ্রামে বাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করতে গিয়ে মানুষও গাছ কাটছেন, জলাশয় ভরাট করছেন। এর ভয়াবহ পরিণতি এখন সবাই ভোগ করছেন।
‘তাপদাহের তীব্রতা: দায় কার? করণীয় কী?’ শীর্ষক এই সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাপার সহসভাপতি ও স্থপতি ইকবাল হাবিব। আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শহীদুল ইসলাম, রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মিহির লাল সেন। সভাপতিত্ব করেন বাপার সভাপতি অধ্যাপক নুর মোহাম্মদ তালুকদার। সঞ্চালক ছিলেন বাপার সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির।
সবুজ, পানি ও উন্মুক্ত জায়গার অভাবে এই তাপপ্রবাহে রাজধানীতে স্বস্তি নেই বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শহীদুল ইসলাম। তিনি বলেন, স্বস্তি নষ্ট হওয়ার পেছনে দায়ী দুটি শক্তি। এক, ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিজেরা, আরেকটি হচ্ছে রাষ্ট্র সরাসরি দায়ী। রাষ্ট্র একদিকে বলছে বন তৈরি করো, আরেক দিকে রাস্তার গাছ কাটছে।
অনুষ্ঠানে স্থপতি ইকবাল হাবিব ‘নগর তাপদাহের তীব্রতা: প্রেক্ষিত ও প্রত্যাশা’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধে বলেন, জলাশয় কমে যাওয়ায় পর্যাপ্ত গাছ না থাকা, পরিবেশ অনুপযোগী বিদেশি গাছ রোপণ, কাচের ভবন নির্মাণ, বায়ুদূষণ, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি—এসব কারণে চলমান তাপপ্রবাহে ঢাকার পরিবেশ অসহনীয় হয়ে উঠেছে। যা তাপমাত্রা থাকছে, তার চেয়ে বেশি অনুভূত হচ্ছে। এর প্রধান ভুক্তভোগী স্বল্প আয়ের মানুষ।
নিজের প্রবন্ধে ইকবাল হাবিব বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) ২০২৩ সালের একটি গবেষণার তথ্য তুলে ধরে বলেন, গত ২৮ বছরে রাজধানী থেকেই প্রায় ৮৫ ভাগ জলাভূমি হারিয়ে গেছে। পাশাপাশি একই সময়ে স্থাপনা নির্মাণ বেড়েছে ৭৫ ভাগ, যা গাছপালা ও জলাশয় ধ্বংস করে তৈরি করা হয়েছে।
প্রবন্ধে আরও কিছু গবেষণার তথ্য তুলে ধরা হয়, যেখানে প্রকৃতি বিনাশের চিত্র উঠে এসেছে। যেমন: বেসরকারি সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের একটি গবেষণার তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, ১৯৭৩ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে সুন্দরবনের ঘন বনাঞ্চল ২৭ ভাগ কমেছে। অন্যদিকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে বার্ষিক ২ দশমিক ৬ শতাংশ হারে বন উজাড় হয়েছে, যা বৈশ্বিক গড় হারের প্রায় দ্বিগুণ।
তাপপ্রবাহে মানুষের যে দুর্ভোগ, এর দায় সরকারের ও রাষ্ট্রযন্ত্রের বলে উল্লেখ করেন বাপার সহসভাপতি ইকবাল হাবিব। তবে তিনি বলেন, সরকারের পাশাপাশি মানুষের ব্যক্তিগত লোভও বর্তমানের অসহনীয় পরিস্থিতির জন্য অনেকাংশে দায়ী। পুঁজিকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনাও পরিবেশের ক্ষতি করছে।
ঢাকার কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ, যাত্রাবাড়ী, বাবুবাজার, বাসাবো, গাবতলী, সায়েদাবাদ, ফার্মগেট—এসব জায়গায় ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য জলাধার বা বৃক্ষশোভিত ছায়ার মতো উপকরণ নেই বলে উল্লেখ করেন ইকবাল হাবিব। তিনি বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করতে যে পরিমাণ অর্থ খরচ করা হচ্ছে, তার চেয়ে কম খরচে ফুটপাতের সঙ্গে গাছ লাগিয়ে সবুজ আচ্ছাদিত নতুন ঢাকা সৃষ্টি করা সম্ভব।
প্রয়োজনে নদী ও খালের জমি অধিগ্রহণ করে জলাধার সংরক্ষণ করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান ইকবাল হাবিব। তিনি বলেন, মাত্র কয়েক হাজার মানুষের জন্য ঢাকার কোটি মানুষের জীবন বিপন্ন হতে পারে না। সরকারকে নগর দর্শনের ধারণা বদলাতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।
ফার্মগেটের আনোয়ারা উদ্যানের জায়গায় মার্কেট করতে চায় মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ—সংবাদ সম্মেলনে এমন এক প্রশ্নের জবাবে ইকবাল হাবিব বলেন, বাপার পক্ষ থেকে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে বলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, খবরদার। এটি অসম্ভব একটি অন্যায় আবদার। পার্কিংয়ের জন্য যেটুকু জমি একান্ত দরকার, তার বাইরে এক ইঞ্চি জায়গাও যদি থাকে, ফেরত দিতে হবে।
অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, দূষণের কারণে তাপমাত্রা আরও বেড়েছে। গত ২০-২৫ বছরে দেশে এমন কোনো কাজ হয়নি যা দূষণ কমাতে সহযোগিতা করে।
তাপদাহ-সংক্রান্ত বিপর্যয় রোধে এবং ঢাকা শহরের প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় অনুষ্ঠানে আট দফা দাবি তুলে ধরে বাপা। এর মধ্যে রয়েছে বন ও বনভূমি রক্ষায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহি করা এবং আইনভঙ্গকারীদের শাস্তির আওতায় আনা। সড়ক ব্যবস্থাপনায় থাকা সংস্থাগুলোর নির্বিচার বৃক্ষ নিধন বন্ধ করা। যত্রতত্র কাচের ভবনের ‘আত্মঘাতী সংস্কৃতির’ বিপরীতে প্রকৃতি–নির্ভর নগর দর্শনকে গুরুত্ব দেওয়া।
যেখানে দেশে ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা দরকার ছিল, সেখানে তা ১০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে উল্লেখ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মিহির লাল সেন। তিনি বলেন, এখন থেকে উদ্যোগ নিয়ে বনায়নকে অন্তত ২০ শতাংশে নিয়ে যেতে হবে। দেশে ‘দানবের’ মতো পরিবেশ ধ্বংস করা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
প্রকৃতিকে রক্ষা করার জন্য সবার আগে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন বলে মনে করেন বাপার সভাপতি অধ্যাপক নুর মোহাম্মদ তালুকদার। তিনি বলেন, এখন রাজনীতি হয়ে গেছে শুধু ক্ষমতার জন্য, প্রাণ–প্রকৃতি রক্ষায় মনোযোগ কম।