ছাপরাখালীর রানির বোটম্যান কিছুতেই কচিখালী যেতে রাজি না। এপ্রিলের শেষের দিক। এ সময় উপকূলীয় বাতাসে তীব্রতা বাড়ে, সেই সঙ্গে উত্তরের আকাশ কালো করে ধেয়ে আসে কালবৈশাখী। ফলে এ সময় কোনো লঞ্চ দক্ষিণ সুন্দরবনে যেতে চায় না। বেসরকারি সংস্থা ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশের গবেষণা বোট ছাপরাখালীর রানির বোটম্যান মন্টু মিয়া গোঁ ধরেছেন কিছুতেই কচিখালী যাবেন না। শেষমেশ সুপতি পর্যন্ত যেতে রাজি হলেন।
চাঁদপাই অফিস থেকে প্রহরী নিয়ে সকাল সকাল রওনা দিলাম। বন-বনানী দেখতে দেখতে সন্ধ্যার দিকে সুপতি স্টেশনের জেটিতে বোট থামল। সারা দিন পর বোট থেকে নেমে জেটি অফিসের আশপাশে হেঁটে বেশ ভালো লাগল। সুপতি ফরেস্ট স্টেশনটির সঙ্গে কতশত স্মৃতি জমা আছে, সুন্দরবনের আর কোনো অফিসের সঙ্গে তেমনটা নেই।
সুন্দরবনে গিয়ে সুপতি অফিসের দক্ষিণের ছোট্ট পুকুরে সাঁতার কেটে গোসল করিনি, এমনটি বোধ হয় হয়নি কখনো। ছিমছাম পুকুর, শানবাঁধানো ঘাট, পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে পুকুরের পাড় পর্যন্ত সুন্দরীর গভীর বন। ঘাটে নেমে পানিতে পা দিলেই ছোট ছোট মাছ ঘিরে ধরে। আর দক্ষিণ-পূর্ব কোনায় এসে বাঘ পানি পান করে নিয়মিত। ফলে গোসলের সময় নজর রাখতে হয় বনের দিকে। তারপরও গরমের দিনে পুকুরের ঠান্ডা পানির গোসলে শরীর-মন বেশ সতেজ হয়ে ওঠে।
সুপতি জেটিতেই রাত কাটল। পরদিন সকাল হতেই সাম্পান নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ি বাদামতলা খালের দিকে। সুন্দরবনের বন্য প্রাণীর ওপর জরিপকাজ। জেটি থেকে প্রায় ২০০ মিটার সামনে যেতেই আচমকা সুপতি খালের পানিতে ভেসে উঠল একজোড়া ডলফিন। একটি দেখতে হালকা বেগুনি, অন্যটি গোলাপি। কিছু দূর যায়, আবার ভেসে ওঠে। আলতো করে পিঠ ভাসিয়ে দিয়ে পিঠের ওপর থাকা ছোট নাকে অক্সিজেন নিয়ে আবার তলিয়ে যায় পানিতে। সুপতি খালের মুখ থেকে দুধমুখী খালের দিকে এগিয়ে চলেছে। চলার গতি বেশ ধীর। শিকারের পেছনে ছুটছে না, এটি নিশ্চিত করে বলা যায়। মাঝেমধ্যে খুনসুটি করছে, জলকেলিতে মেতে উঠছে, প্রণয়ের ভাব আছে বলে মনে হলো। সকাল সকাল ওদের দেখে মনটা খুশিতে নেচে উঠল। এরা সুন্দরবনের সুন্দরী গোলাপি ডলফিন। ইংরেজি নাম ইন্দো-প্যাসিফিক হামব্যাক ডলফিন।
গোলাপি ডলফিন অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন। হংকং, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর ও চীনে এটি সাদা ডলফিন নামে পরিচিত। দেহে রঙের বৈচিত্র্য আছে—ধূসর, গোলাপি কিংবা এ দুইয়ের সংমিশ্রণ থাকতে পারে। অনেক সময় সাদাটে কিংবা হালকা বেগুনিও হয়। দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য চামড়ার নিচে অতিরিক্ত রক্তনালি থাকায় এদের রং গোলাপি হয়। বিশেষ করে চীন ও থাইল্যান্ডের উপকূলীয় এলাকায় এমন ডলফিন বেশি দেখা যায়। এদের দেহ বলিষ্ঠ, লম্বাটে, মাথার সামনে লম্বা ঠোঁট। পিঠের পাখনার সামনে-পেছনে কুঁজো থাকে। লেজ বইঠার মতো ওপর-নিচ চ্যাপটা। লম্বায় ১২ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। আর ওজন হতে পারে সর্বোচ্চ ২৩০ কেজি।
এরা জলজ স্তন্যপায়ী। শ্বাস নিতে কয়েক মিনিট পরপর পানির ওপরে চলে আসে, বাতাস থেকে অক্সিজেন নিয়ে আবার ডুব দেয়। তবে গভীরে ডুব দিয়ে একটানা ৮ মিনিট পর্যন্ত থাকতে পারে। এরা বাচ্চা প্রসব করে, মা ডলফিন বাচ্চাকে দুধ পান করিয়ে বড় করে তোলে। পানির গভীরে কেমন করে বাচ্চা প্রসব করে, কীভাবে বাচ্চাকে স্তন্য পান করিয়ে স্বাবলম্বী করে তোলে, কতটা পারদর্শী এই ডলফিনের মায়েরা!
গোলাপি ডলফিন ছোট দলে চলাচল করে, সংখ্যায় ১০টির বেশি হয় না। দলে থাকলে শিকার ধরতে সুবিধা হয়। বাংলাদেশের উপকূলীয় লোনাপানিতে কদাচিৎ দেখা যায়। এটি সুন্দরবনের মোহনাঞ্চলে মাঝেমধ্যে দেখা মেলে। মাছ, অক্টোপাস, স্কুইড প্রধান আহার এদের। জেলেদের ফাঁস জালে আটকে মারা যায়। সুন্দরবনের এমন বিরল প্রাণী নিয়ে তেমন গবেষণা নেই, ফলে এদের সম্পর্কে আমাদের জানাশোনার ঘাটতি আছে।
লেখক: অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়