দুর্লভ ফুলে ভরা ক্যাম্পাস

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দুষ্প্রাপ্য ফুল কনকচাঁপা
ছবি: লেখক

২০২০ সালের আগস্ট মাসে করোনার বিধিনিষেধ কিছুটা শিথিল হতে হতে বৃক্ষরোপণের মৌসুম চলে আসে। আমরা কিছু সংরক্ষিত স্থানে গাছ লাগানোর প্রস্তুতি নিলাম। একদিন কথা হলো অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদের সঙ্গে। জানালেন, রংপুরে তাঁদের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও তিনি কিছু গাছ লাগাতে চান।

তুহিন ওয়াদুদ সে বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল শিক্ষকতাই করেন না; নদী রক্ষা আন্দোলন, উদ্ভিদ রোপণ, ফটোগ্রাফি—এ রকম নানা দায়িত্বে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন। ন্যাড়া ক্যাম্পাসে তাঁরা এরই মধ্যে কিছু গাছ লাগিয়েছেন। দিনের বেলা সময় না পেলে রাতে ঘুরে ঘুরে দেখেন ক্যাম্পাসের গাছগুলো। কোনো গাছ চিনতে না পারলে ফোন করে তার বংশপরিচয় জানতে চান। এ এক আশ্চর্য নেশা!

চৈত্র শেষে ফুটতে শুরু করেছিল কুরচি

যে ক্যাম্পাসে তাঁর এত উত্তেজনা, সেখানে কিছু দেশি প্রজাতির উদ্ভিদ না হলে কি চলে, বিশেষ করে যেসব গাছ কিছুটা দুর্লভ আর বিপন্ন হয়ে উঠেছে? নানা উৎস থেকে ১০০ প্রজাতির দুর্লভ আর বিপন্ন গাছের চারা সংগ্রহ করা গেল। পাঠানোরও ব্যবস্থা করা হলো। কিন্তু তুহিন ওয়াদুদ বললেন, আমাকেও যেতে হবে। আমাকেও উপস্থিত থেকে গাছ লাগাতে হবে। তা-ই হলো।

২০২০ সালের ধারাবাহিকতায় ২০২১ আর ২০২২ সালেও গাছ লাগানো অব্যাহত রইল। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেসব গাছ লাগানো হয়েছে, তার তালিকা বিশাল। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গাছের নাম জানিয়ে রাখি—চিক্রাশি, ঢাকিজাম, ধূপগাছ, উদাল, কুরচি, বাঁশপাতা, কুম্ভি, পালাম, সিঁদুর, তেলশুর, কুসুম, বৈলাম, স্বর্ণ অশোক, সুলতানচাঁপা, হিমঝুরি, দেবকাঞ্চন, গান্ধীগজারি, রক্তন, রাতা, তূণ, কুসুম, কানাইডিঙা, হলদু, পুত্রঞ্জীব, করমচা, পিয়াল, পরশপিপুল ইত্যাদি।

কয়েক বছরে তুহিন ওয়াদুদ ক্যাম্পাসে যেসব উদ্ভিদ রোপণ করেছেন, সেসবে এখন প্রাণের বান ডেকেছে। বহু গাছে ফুটতে শুরু করেছে দুষ্প্রাপ্য ফুল। মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে ফুটেছে বান্দরহুলা বা রামডালু। ভাবিনি এত দ্রুত এই ফুল ফুটবে। দীর্ঘ ঝুলন্ত ডালপালায় গঠনসৌষ্ঠবে অনন্য এই বৃক্ষ আমাদের সমতলে বড় একটা দেখা যায় না। এ বছর খাগড়াছড়ি থেকে সাজেক যাওয়ার পথে দেখেছি বেশ কিছু গাছ। প্রায় এক যুগ দেখেছিলাম মিরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনে।

সাদা ও সুগন্ধি এ ফুলের নাম বনআসরা

আগেই বলে রেখেছিলাম, এ বছর কনকচাঁপাও ফুটতে পারে। চৈত্রের শেষ দিকেই কনকচাঁপা ফুটল। এ-ও আমাদের অতি পুরোনো আর দুষ্প্রাপ্য ফুল। বন-পাহাড়ের এই গাছ ঢাকায় আছে হাতে গোনা কয়েকটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ প্রাঙ্গণ, শিশু একাডেমির বাগান আর রমনা পার্কে চোখে পড়ে। বর্ণ আর গন্ধ—দুইয়ে মিলে এ ফুল অনুপম।

চৈত্র শেষে দু-একটি করে কুরচি ফুলও ফুটতে শুরু করেছিল। স্থানবিশেষে এ ফুল কুটজ বা গিরিমল্লিকা নামেও পরিচিত। বাংলা একাডেমি, বলধা গার্ডেন, বোটানিক্যাল গার্ডেন, রমনা পার্ক, কার্জন হল প্রাঙ্গণ, শিশু একাডেমির বাগান, ধানমন্ডির কয়েকটি সড়ক আর সদরঘাটে ন্যাশনাল হাসপাতালে এ গাছ দেখা যায়। এ ফুলের বৈশিষ্ট্য শুভ্রতা আর সুগন্ধি।

বৈশাখের প্রথম ভাগেই সাক্ষাৎ পাওয়া গেল বনআসরা ফুলের। এ ফুল আসে নানা কায়দা করে। কলি আসার আগে ডালের আগায় ঝালরের মতো একটি আবরণ পড়ে। কিছুদিন পর কচি ঢ্যাঁড়সের মতো কলি দেখা যায়। এ দুই প্রক্রিয়াতে বেশ সময় লাগে। এরপর ফোটে ফুল। আকারে বড়, প্রায় ৮ সেন্টিমিটার চওড়া, গুচ্ছবদ্ধ বা একক, সাদা ও সুগন্ধি। রমনা পার্ক, বোটানিক্যাল গার্ডেনসহ দেশের মিশ্র চিরসবুজ বনে দেখা যায়।

একসময়ের উদ্ভিদহীন ধু ধু প্রান্তর এই বিশ্ববিদ্যালয় এখন সবুজে মোড়ানো। প্রায় এক দশকের ব্যবধানে ক্যাম্পাসে গাছের সংখ্যা হয়েছে ৩৭ হাজার। প্রজাতির সংখ্যা ৪০০। বিরল প্রজাতির নানা গাছ দেখতে দূরদূরান্ত থেকে এখন দর্শনার্থীরাও সেখানে আসছেন।

  • মোকারম হোসেন, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক