বুড়িগঙ্গার পাড়ের মাটির গভীরে প্লাস্টিকের উপস্থিতি বিশেষজ্ঞদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি করেছে।
বুড়িগঙ্গার পাড়ের মাটি খুঁড়লেই পাওয়া যাচ্ছে প্লাস্টিক। মাটির অন্তত সাত ফুট নিচেও মিলছে প্লাস্টিকের দেখা। পাড়ের এসব প্লাস্টিক পরে গিয়ে জমা হয় নদীর তলদেশে। দেখা গেছে, মাটির নিচের কোনো কোনো প্লাস্টিক এক যুগের বেশি পুরোনো। আর তা রয়ে গেছে প্রায় একই রকম, অবিকৃত।
বুড়িগঙ্গাপাড়ের মাটিতে প্লাস্টিকের উপস্থিতি নিয়ে চলমান এক গবেষণায় এমন চিত্র পাওয়া গেছে। এ গবেষণাটি করছে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)।
বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ, ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যা—ঢাকার চারপাশে এই যে পাঁচটি নদ–নদী আছে, তার তলদেশে এবং ভাসমান অবস্থায় যে প্লাস্টিক আছে, তা নিয়ে নানা আলোচনা আছে। এর মধ্যে বুড়িগঙ্গাপাড়ের মাটির গভীরে প্লাস্টিকের উপস্থিতি নিয়ে এই গবেষণার ফল বিশেষজ্ঞদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি করেছে।
দেশে সারা বছর যে পরিমাণ বর্জ্য তৈরি হয়, তার ১০ শতাংশ প্লাস্টিক পণ্য থেকে আসে। এর ৪৮ শতাংশ মাটিতে পড়ে, আর ৩৭ শতাংশ পুনরায় ব্যবহৃত হয়। ১২ শতাংশ পড়ে খাল ও নদীতে। আর ৩ শতাংশ নালাতে গিয়ে মেশে।
আজ ৫ জুন পালিত হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘প্লাস্টিক দূষণ সমাধানে, শামিল হই সকলে’।
দেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়ছে। ২০২১ সালে দেওয়া বিশ্বব্যাংকের ‘টুয়াডর্স আ মাল্টিসেক্টরাল অ্যাকশন প্ল্যান ফর সাসটেইনেবল প্ল্যাস্টিক ম্যানেজমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের শহরাঞ্চলে মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ ২০০৫ সালে ছিল ৩ কেজি। ২০২০ সালে এটি বেড়ে হয়েছে ৯ কেজি। ঢাকা শহরে বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ এ সময়ে ৯ থেকে ২৪ কেজি হয়েছে। দেশে সারা বছর যে পরিমাণ বর্জ্য তৈরি হয়, তার ১০ শতাংশ প্লাস্টিক পণ্য থেকে আসে। এর ৪৮ শতাংশ মাটিতে পড়ে, আর ৩৭ শতাংশ পুনরায় ব্যবহৃত হয়। ১২ শতাংশ পড়ে খাল ও নদীতে। আর ৩ শতাংশ নালাতে গিয়ে মেশে। মাটিতে পড়া প্লাস্টিকের বড় অংশ পলিথিন ব্যাগ, পণ্যের মোড়ক ও প্যাকেট হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া।
বুড়িগঙ্গাপাড়ের প্রতি টন মাটিতে কী পরিমাণ প্লাস্টিক আছে, কত গভীরে এর অস্তিত্ব বা কতটা কম বা বেশি আছে, সেটা জানতেই এই গবেষণা।ক্যাপসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার
ঢাকায় ব্যবহৃত হওয়া প্লাস্টিকের একটা অংশের গন্তব্য বুড়িগঙ্গা নদী। কেউ কেউ অনুমান করেন, বুড়িগঙ্গার তলদেশে ১০ থেকে ১২ ফুটের প্লাস্টিকের স্তর আছে। তবে এর সঠিক প্রমাণ মেলেনি। আসলে নদীতে প্লাস্টিকের দূষণ কোন পর্যায়ে আছে—সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই ক্যাপসের এই গবেষণা, জানান প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বুড়িগঙ্গাপাড়ের প্রতি টন মাটিতে কী পরিমাণ প্লাস্টিক আছে, কত গভীরে এর অস্তিত্ব বা কতটা কম বা বেশি আছে, সেটা জানতেই এই গবেষণা।’
এ গবেষণা শুরু হয় গত মে মাসে। বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশের পাঁচ নদ–নদীতে প্লাস্টিকের অস্তিত্ব নিয়ে গবেষণা চলবে। এ জন্য পাঁচ নদ–নদীর পাড়ের ১০০টি স্থান থেকে মাটি সংগ্রহ করা হবে। আর ইতিমধ্যে শুধু বুড়িগঙ্গায় সাতটি স্থান থেকে মাটি সংগ্রহ করা হয়েছে। মাটি খোঁড়া হয়েছে সাত ফুট পর্যন্ত। আর সেই পর্যন্ত মাটির বিভিন্ন অংশে প্লাস্টিকের উপস্থিতি পেয়েছেন ক্যাপসের গবেষকেরা।
মাটির ওপরে প্লাস্টিক থাকলে এর পচন কিছুটা দ্রুত হয়। কিন্তু মাটির ভেতরে থাকার অর্থ হলো এর পচনে দীর্ঘ সময়ের দরকার হবে। এতে মাটির অভ্যন্তরে পানির পুনর্ভরণ হওয়ার প্রক্রিয়াটিই নষ্ট হয়ে যায়। এটা নদীর প্রকৃতিবিরুদ্ধ।বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও পানিবিশেষজ্ঞ ফিরোজ আহমেদ
বুড়িগঙ্গাপাড়ের মাটি সরাসরি তুলে এনে ছাঁকনিতে ফেলে ছাঁকা হয়। ন্যূনতম এক টন এবং সর্বোচ্চ চার টন পর্যন্ত মাটি সংগ্রহ করা হয়। এসব প্লাস্টিক কত পুরোনো, সেটা দেখাও ছিল গবেষণার উদ্দেশ্য।
অধ্যাপক কামরুজ্জান মজুমদার বলেন, ‘প্লাস্টিকের বয়স দেখতে কার্বন ম্যাপিং করা যেত। কিন্তু আমরা তা করিনি। আমরা প্লাস্টিকের গায়ে এর উৎপাদনের তারিখ দেখেছি। কোনো কোনো প্লাস্টিক দেখেছি, যেগুলো উৎপাদিত হয়েছে ২০১০ সাল। সেই প্লাস্টিক খুব বেশি একটা পচেওনি, নষ্টও হয়নি।’
নদীপাড়ের এই প্লাস্টিক মাইক্রো প্লাস্টিকে রূপান্তরিত হয়ে নদীতে মিশতে পারে। তা হতে পারে মাছের খাদ্য। সেই মাছ মানুষ খেলে তাদের শরীরেও প্রবেশ করতে পারে প্লাস্টিকঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান হারুন অর রশীদ খান
গবেষণায় নদীর যে পাড় থেকে মাটি সংগ্রহ করা হয়েছে, তা সাধারণত জোয়ারের সময় পানিতে ডুবে যায়। বর্ষায় তা দীর্ঘ সময় থাকে জলমগ্ন। তাই এসব প্লাস্টিক শেষাবধি চলে যায় নদীর তলদেশে। আর এটাকেই বড় দুশ্চিন্তার কারণ বলছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও পানিবিশেষজ্ঞ ফিরোজ আহমেদ। তিনি বুড়িগঙ্গার দূষণ নিয়ে একাধিক গবেষণা করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাটির ওপরে প্লাস্টিক থাকলে এর পচন কিছুটা দ্রুত হয়। কিন্তু মাটির ভেতরে থাকার অর্থ হলো এর পচনে দীর্ঘ সময়ের দরকার হবে। এতে মাটির অভ্যন্তরে পানির পুনর্ভরণ হওয়ার প্রক্রিয়াটিই নষ্ট হয়ে যায়। এটা নদীর প্রকৃতিবিরুদ্ধ।’
প্লাস্টিক ভেঙে মাইক্রো প্লাস্টিকে রূপান্তরিত হতে পারে। তখন এটি মানুষের খাদ্যচক্রে মিশে ভয়ংকর ফল বয়ে আনতে পারে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান হারুন অর রশীদ খান। তিনি বলেন, ‘নদীপাড়ের এই প্লাস্টিক মাইক্রো প্লাস্টিকে রূপান্তরিত হয়ে নদীতে মিশতে পারে। তা হতে পারে মাছের খাদ্য। সেই মাছ মানুষ খেলে তাদের শরীরেও প্রবেশ করতে পারে প্লাস্টিক।’