গত এক যুগে ঢাকার আশপাশে আটটি ভূমিকম্প হয়েছে। এর আগের ভূমিকম্পগুলোর বেশির ভাগ কেন্দ্রস্থল ছিল সিলেট ও চট্টগ্রাম এলাকায়।
চলতি বছরের দুটি ভূমিকম্পের ধরনের সঙ্গে প্রায় ২১১ বছর আগে হওয়া ভূমিকম্পের একটি মিল আছে। ১৮১২ সালের এপ্রিল ও মে মাসে ঢাকার আশপাশে পরপর দুটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। ওই ভূমিকম্প ঠিক কত মাত্রার ছিল, তা নিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও এতে ঢাকার দুটি এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পাওয়া যায়। যেসব এলাকার ভূ-অভ্যন্তরে চ্যুতি বা ফাটল থাকে, সেখানে প্রতি ২০০ থেকে ২৫০ বছর পরপর মাঝারি থেকে তীব্র ভূমিকম্প হয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সেই হিসাবে ঢাকার আশপাশে বড় ধরনের ক্ষতি করতে পারে—এমন ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়ছে।
বাংলাদেশ সময় গতকাল শুক্রবার ভোর ৫টা ৫৭ মিনিটে ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় একটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তথ্য অনুযায়ী, রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৩। এর উৎপত্তিস্থল ঢাকার দোহার থেকে ১৪ কিলোমিটার পূর্বে-দক্ষিণ-পূর্বে। ভূপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার গভীরে ছিল ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল। ভূমিকম্পের সময় ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ভয় ও আতঙ্ক তৈরি হয়। অনেকে ভোরে ঘর থেকে বের হয়ে যান। তবে এখন পর্যন্ত এতে ক্ষয়ক্ষতির কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
এর আগে গত ২৫ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ৪ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্প হয়। ওই ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ভূগর্ভের প্রায় ১৭ কিলোমিটার নিচে হওয়ায় নগরবাসী তা খুব বেশি বুঝতে পারেনি। সাধারণত, ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল যত গভীরে হয়, কম্পনের অনুভূতি তত কম হয়। আর কেন্দ্রস্থল ওপরের দিকে হলে কম্পনের অনুভূতি বেশি হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের হিসাবে, গত ৪৮৫ বছরে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের ভেতরে ও ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে ৫২টি মৃদু, মাঝারি ও তীব্র মাত্রায় ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে মাত্র ছয়টি ভূমিকম্প হয়েছিল ঢাকা ও এর আশপাশে। গত এক যুগেই ঢাকার আশপাশে মোট আটটি ভূমিকম্প হয়েছে। এসব ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী ও দোহারে। এর আগের ভূমিকম্পের বেশির ভাগ কেন্দ্রস্থল ছিল সিলেট ও চট্টগ্রাম এলাকায়।
এর আগে গত ২৫ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ৪ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্প হয়। ওই ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ভূগর্ভের প্রায় ১৭ কিলোমিটার নিচে হওয়ায় নগরবাসী তা খুব বেশি বুঝতে পারেনি। সাধারণত, ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল যত গভীরে হয়, কম্পনের অনুভূতি তত কম হয়। আর কেন্দ্রস্থল ওপরের দিকে হলে কম্পনের অনুভূতি বেশি হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৈয়দ হুমায়ুন আখতারের হিসাবে, ‘গত এক যুগে ঢাকার আশপাশে ভূমিকম্পের সংখ্যা বাড়ছে। ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সময়ে কুমিল্লা ও চাঁদপুর জেলায় ছয়টি ভূমিকম্প হয়েছিল। এরপরের বছরগুলোতে ভূমিকম্পগুলোর কেন্দ্রস্থল ছিল মূলত সিলেট, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকার মধ্যে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভূমিকম্পের কেন্দ্র ঢাকার আশপাশে বেশি দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে যাওয়া ভূ-অভ্যন্তরের বার্মা প্লেটের নিচে ইন্ডিয়ান প্লেট চাপা পড়ে যাচ্ছে। যে কারণে সেখানে প্রচুর শক্তি জমা হচ্ছে। ওই শক্তি যেকোনো সময় বের হয়ে শক্তিশালী কম্পন সৃষ্টি করতে পারে। ফলে ভূমিকম্প মোকাবিলায় থেমে থাকা কাজ আমাদের এখনই দ্রুত শুরু করতে হবে।’
ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের হিসাবে, গত এক মাসে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে মোট ১৪টি মৃদু থেকে মাঝারি ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের ভেতরে হয়েছে দুটি। যার একটি গত ২৫ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে, রিখটার স্কেলে ৪ মাত্রায়। আর সর্বশেষটি গতকাল ভোরে ঢাকার ১৪ কিলোমিটার দূরে দোহারের কাছে, ৪ দশমিক ৩ মাত্রার।
রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করার কাজ এগোয়নি
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের হিসাবে, ঢাকা শহরে ভবন আছে ২১ লাখ। এর মধ্যে ৬ লাখ ভবন ছয়তলা বা এর চেয়ে উঁচু। ভূমিকম্পে মানুষের মৃত্যুর ৯০ শতাংশই হয় ভবনধসে। ২০১৫ সালে নেপালে ভূমিকম্পের পর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকার ভবনগুলোর ভূমিকম্প ঝুঁকি চিহ্নিত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোকে লাল ও কম ঝুঁকিপূর্ণগুলোকে সবুজ রং দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু কয়েক দফা এই বিষয় নিয়ে আলাপ হলেও তা এগোয়নি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশের ১৩টি এলাকা ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। ভূগর্ভস্থ ফাটল বা চ্যুতি থাকার কারণে ওই কম্পন হতে পারে। সবচেয়ে তীব্র ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা ও সিলেটের জৈন্তাপুর এলাকা। সব এলাকাই ঢাকা থেকে কমপক্ষে ১০০ কিলোমিটার দূরে।
সর্বশেষ গত মার্চে তুরস্কে ভূমিকম্পের পর রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) রাজধানীর ভূমিকম্পের ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করার জন্য একটি সভা করে। ২২ মার্চের ওই সভায় আগামী এক মাসের মধ্যে ওই প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার কথা বলা হয়েছিল; কিন্তু তা আর হয়নি।
জানতে চাইলে রাজউক চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান মিঞা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা গত বৃহস্পতিবার ভূমিকম্প নিয়ে একটি সভা করেছি। এর আগে আমরা একটি প্রকল্পের আওতায় ঢাকার ভূমিকম্পের জন্য সাড়ে তিন হাজার ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করেছি। তবে ঢাকা শহরের সব ভবনের ওপরে জরিপ চালানো আমাদের একার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আমরা তৃতীয় কোনো পক্ষকে দিয়ে ওই জরিপ করে দ্রুত এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’
১৩টি এলাকা ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশের ১৩টি এলাকা ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। ভূগর্ভস্থ ফাটল বা চ্যুতি থাকার কারণে ওই কম্পন হতে পারে। সবচেয়ে তীব্র ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা ও সিলেটের জৈন্তাপুর এলাকা। সব এলাকাই ঢাকা থেকে কমপক্ষে ১০০ কিলোমিটার দূরে। কিন্তু সেখানে ৭ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে তা ঢাকায় বড় ধরনের বিপর্যয় তৈরি করতে পারে।
দেশের ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর ১০০ থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে ৭ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকায় তীব্র কম্পন অনুভূত হতে পারে, যা এই শহরের দুর্বল ভবনগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। ঢাকার সম্প্রসারিত বা নতুন নতুন আবাসিক এলাকার মাটি নরম ও দুর্বল। এ ধরনের মাটিতে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা না মেনে বহুতল ভবন হলে তা মাঝারি মাত্রার কম্পনেই ভেঙে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ মেহেদী হাসান আনসারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাধারণত কোথাও ভূমিকম্প হলে বিভিন্ন পক্ষ এ নিয়ে নড়েচড়ে বসে। কিন্তু গত বছর ও চলতি বছরের প্রথম কয়েক মাসে যেভাবে বাংলাদেশের আশপাশে ভূমিকম্প বাড়ছে, তাতে ঢাকার আশপাশে যে বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা আছে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। ফলে বড় বিপর্যয়ের আগেই আমাদের দ্রুত সাবধান হতে হবে। শহরটিকে ভূমিকম্প সহনশীল করে গড়ে তোলার কাজে দেরি করা যাবে না।’