বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ উদ্যানে গিলা ফল
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ উদ্যানে গিলা ফল

দুষ্প্রাপ্য গিলালতা

গিলালতার বহুমাত্রিক ব্যবহার রয়েছে। বিশেষ করে গিলা ফলের ব্যবহার আমাদের ঐতিহ্যধারার অংশ হয়ে আছে। ফলটির লোকজ ব্যবহারের চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায় কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের লেখায়। তিনি নিজেরে করো জয় গ্রন্থে লিখেছেন, ‘...এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সকালের আর একটি ঘটনার কথা মনে পড়ল। এটিও একটি লতাগাছের কথা। গিলালতা।

মৃত্তিকা চাকমার বাড়িতে এবং পরে সুগত চাকমার বাড়িতে বেশ বড় আকারের গিলা দেখেছিলাম। গিলা দেখতে পাওয়া ছিল আমার জন্য বিস্ময়। কৈশোরে-যৌবনে আমরা গিলা দেখতাম বিভিন্ন দোকানে। গিলার রং কালচে খয়েরি এবং আকারে গোল। এই গিলা দিয়ে পাঞ্জাবির হাত দুটোতে ভাঁজ ফেলা হতো। বলা হতো গিলাকরা পাঞ্জাবি। সে সময়ে এমন পাঞ্জাবি ছিল ফ্যাশন।’

আমাদের প্রকৃতিতে বেড়ে ওঠা গিলালতা আশ্চর্য এক উদ্ভিদ যেন। সুযোগ পেলে এই লতা এক কিলোমিটার দূরত্বেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। শুধু তা-ই নয়, পরিণত বয়সে লতানো এই গাছের কাণ্ড রীতিমতো স্বাভাবিক গাছের কাণ্ডের মতো হয়ে উঠতে পারে। সুবিশাল মোটা কাণ্ডের এমন একটি লতা দেখেছিলাম ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ উদ্যানে। এই লতা বনের ভেতর বিশাল এলাকাজুড়ে অনেক গাছকে জড়িয়ে জীবন্ত সেতুও তৈরি করতে পারে। গিলালতার খ্যাতি মূলত তার ফলের জন্যই। কারণ, লতানো গাছে এমন দীর্ঘাকৃতির ফল সচরাচর দেখা যায় না। জানামতে, শিম পরিবারে এটাই সবচেয়ে বড় ফলের গাছ।

গিলালতা (Entada rheedii) মজবুত কাণ্ডের লতাজাতীয় চিরসবুজ উদ্ভিদ। এই গাছ কমপক্ষে ১৪০ মিটার পর্যন্ত দীর্ঘ হতে পারে। জীবন্ত গাছ থেকে শুরু করে যেকোনো বাহনেই এরা অতি দ্রুত বিস্তার লাভ করতে পারে। এই গাছের পাতা যৌগিক এবং পত্রফলক ২ থেকে ৬টি পত্রকযুক্ত থাকে। গাছটির লতানো কাণ্ড মোটা, আঁকাবাঁকা, কিছুটা বিক্ষিপ্ত এবং বেশ শক্তপোক্ত ধরনের। পুষ্পমঞ্জরি ১২ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে।

গিলাপাতা

সরু ও সাদা পাপড়ির ফুলগুলো ফোটে মে মাসের দিকে। অক্টোবর থেকে নভেম্বরের মধ্যে ফলগুলো পরিপক্ব হয়ে ওঠে। প্রতিটি ফলে ১০-১৫টি করে বীজ থাকে। বীজগুলো চ্যাপটা গোলাকার, শক্ত ও গাঢ় লালচে বর্ণের। আমাদের দেশে দরজিরা কাপড়ে চিহ্ন দেওয়ার কাজে গিলার বীজ ব্যবহার করেন। দেশের কোথাও কোথাও এখনো গায়েহলুদের অনুষ্ঠানে গিলার বীজ ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে।

এ ছাড়া গিলালতা চমৎকার ঔষধিগুণসম্পন্ন। গিলার বীজের শাঁস জ্বরে, বাহ্যিক ক্ষত সারাতে এবং চর্মরোগে বেশ কার্যকর একটি মহৌষধ। তা ছাড়া জন্ডিস, দাঁতব্যথা ও আলসারে গিলাগাছের ছাল সেদ্ধ করে সেই ক্বাথ নিয়মিত ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যায়। দক্ষিণ আফ্রিকায় গিলার ফলভাজাকে কফির বিকল্প এবং বিরেচক হিসেবে গণ্য করা হয়। গিলালতা বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, ভুটান, নেপাল ও মালয়েশিয়ায় প্রাকৃতিকভাবে জন্মে।

  • মোকারম হোসেন, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক