আহা কি চমৎকার দেশ আমাদের! জলবায়ু বদলে গেলেও এ দেশের ছয়টি ঋতু স্থায়ীভাবে ঠাঁই করে নিয়েছে আমাদের সাহিত্যে। কাজী নজরুল ইসলামের ‘হেরিনু পল্লী জননী’ গানটি এর শ্রেষ্ঠ প্রমাণ। প্রতিটি ঋতুকে আমরা বরণ করে নিই একেক ফুল দিয়ে। গ্রীষ্মকে বরণ করি কৃষ্ণচূড়া ফুলে, বর্ষাকে কদম দিয়ে, শরৎকে শিউলি ফুলে, হেমন্তকে ছাতিম দিয়ে, শীতকে গাঁদা ফুলে আর বসন্তে তো ফুলের কোনো অভাব নেই; ‘আসে বসন্ত ফুলবনে, শিমুল-পলাশ ফুলের ডালি সাজিয়ে আমরা বরণ করে নিই বসন্তকে।
শীত এলেই তাই শীতের প্রতীক হয়ে ওঠে গাঁদা ফুল। গাঁদা ফুলের কথা ভাবলেই কানে বারবার ভেসে আসে কবি নজরুলের গান, ‘হলুদ গাঁদার ফুল, রাঙা পলাশ ফুল/ এনে দে এনে দে নৈলে রাঁধব না, বাঁধব না চুল।’ গায়েহলুদ থেকে ফুলশয্যা—কোথায় নেই এই হলুদ গাঁদা ফুল? কিন্তু তাই বলে সাদা গাঁদা! হলুদ, কমলা, মেরুণ বা লালচে গাঁদা ফুল অনেক দিন ধরেই এ দেশে গাঁদার জগৎকে আলোময় করে রেখেছে। এবার সাদা গাঁদা ফুলও হলুদ গাঁদাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। বাগানে বাগানে, নার্সারিতে নার্সারিতে এখন দিন দিন বাড়ছে সাদা গাঁদা ফুলের কদর। তবে এই সাদা গাঁদার জন্ম দিতে উদ্যানতাত্ত্বিকদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।
সাদা গাঁদা ফুলের পেছনে একটা গল্প আছে। আমেরিকার বিখ্যাত বীজ কোম্পানি ‘বারপি’ সাদা গাঁদা ফুল উদ্ভাবনের জন্য প্রায় ৫৬ বছর ধরে গবেষণা করে যখন ব্যর্থ হয়েছে, তখন তারা ঘোষণা করে যে যিনি বা যাঁরা প্রথম সাদা গাঁদা ফুলের জন্ম দিতে পারবে, বারপি কোম্পানি তাঁদের ১০ হাজার মার্কিন ডলার পুরস্কার দেবে। তাদের এই ঘোষণায় কয়েক বছর কয়েক হাজার উদ্যানী সাড়া দিয়ে এগিয়ে এলেন, বারপি কোম্পানিও সে আয়োজনে প্রায় আড়াই লাখ মার্কিন ডলার খরচ করে ফেলল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না।
অবশেষে অ্যালিস ভংক (১৯০৮-১৯৯৭) নামের একজন আমেরিকান নারী উদ্যানতত্ত্ববিদ এগিয়ে এলেন সাদা গাঁদা উদ্ভাবনে। তিনি ১১ বছর বয়স থেকেই ফুলের বাগান করেন। কিন্তু এ বিষয়ে তাঁর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। অ্যালিস প্রথমে একেবারে হালকা রঙের কিছু গাঁদা ফুলের বীজ জোগাড় করেন। সেগুলো তিনি তাঁর বাগানে বুনে প্রতিবছরই গাছ তৈরি করেন আর সেসব গাছে ফোটা ফুলগুলোর মধ্যে আবার আরও হালকা রঙের ফুল দেখে দেখে সেসব ফুলের বীজ রেখে আবার পরের বছর বোনেন।
এভাবে তাঁর ২০টি বছর কেটে যায়। অবশেষে ২১ বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালে তিনি সাদা গাঁদা ফুলের জন্ম দিতে সক্ষম হন। সেসব ফুল প্রায় আড়াই ইঞ্চি বড় আর মাখন সাদা রঙের। অবশেষে দীর্ঘদিনের সেই প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ তিনি জিতে নেন বারপি কোম্পানির ঘোষিত ১০ হাজার মার্কিন ডলার পুরস্কার। উদ্ভাবিত হয় সাদা গাঁদার জাত।
গাঁদা ফুলকে আমাদের যতটা আপন মনে হয়, সে আমাদের ততটা আপন নয়, মানে ও আমাদের দেশি ফুল নয়। এসেছে সুদূর দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকা থেকে। জানা যায়, সুপ্রাচীন অ্যাজটেক সভ্যতায় হলুদ গাঁদা ফুল ছিল শক্তি, মর্যাদা ও আভিজাত্যের প্রতীক, যাকে সূর্যের অংশ বলে বিশ্বাস করা হতো। তাদের কাছে গাঁদা ফুল ছিল ভেষজ চিকিৎসারও অন্যতম প্রধান উপকরণ। সেখান থেকে ষোড়শ শতকে স্প্যানিশরা গাঁদা ফুলকে নিয়ে যায় ইউরোপে। ইউরোপীয়দের হাত ধরে গাঁদা ফুল এরপর চলে আসে ভারতীয় উপমহাদেশে।
গাঁদা ফুল ট্যাজেটেস গণের গাছ। বিশ্বব্যাপী এ গণের প্রায় ৫০টি প্রজাতি রয়েছে। আমাদের দেশে Tagetes erecta, Tagetes patula I Tagetes tenuifolia প্রজাতির গাঁদা ফুল চাষ করা হয়। তবে এসব প্রজাতিরও রয়েছে বহু জাত, বহু রঙের ফুল। সবচেয়ে বড় ফুলের হাইব্রিড গাঁদার জাত ‘ইনকা’ এখন সবার মন জয় করে নিয়েছে। সাদা গাঁদা ফুলকে মনে করা হয় শুদ্ধতা ও পবিত্রতার প্রতীক। অন্যদিকে কমলা গাঁদা হলো গভীর প্রণয়ের প্রতীক, হলুদ গাঁদা সৌভাগ্যের এবং লাল গাঁদা প্রেম ও রোমান্টিক ভাবের প্রতীক। গাঁদা ইউক্রেনের জাতীয় প্রতীক। সে দেশের মানুষ বিশ্বাস করে, যে বাড়িতে গাঁদা ফুল থাকে, সে বাড়িতে শয়তান ঢুকতে পারে না।
মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক