প্রকৃতি আপন নিয়মে চলে। সেই নিয়মের পথ ধরে এই বাংলায় আবার এল রূপের রানি শরৎ ঋতু।
শরৎ এবার এল এমন এক পটভূমিতে, যা নতুন ও ভিন্ন। এই তো কদিন আগে শিক্ষার্থীদের দুর্বার আন্দোলনে ভেঙে ছত্রখান হলো দীর্ঘদিন ধরে চেপে বসা জগদ্দল পাথরটি! সরকার পরিচালনায় নতুন যে কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়েছে, শিক্ষার্থীরাও এর অংশ। তবে ‘রক্তের দাগ শুকায় নাই’। তাই দাবি উঠেছে ন্যায়বিচারের।
এমনই দিনে বাংলার প্রকৃতিতে এল মনভোলানো রূপের ঋতু শরৎকাল। কাশফুলের অবারিত স্বাধীনতা, সুনীল আকাশে পেঁজা তুলার মতো আলস্যে ভেসে বেড়ানো মেঘ, পথ হারানো সাদা বকের সারি, মনমাতানো সুখে প্রজাপতি-ফড়িংয়ের ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ নাচানাচি, বাতাসে শিউলির তাজা ঘ্রাণ, ধানখেতে নুয়ে থাকা সোনাঝরা শিষ, নদীর পানিতে ভরা জোছনার ছায়া—এসবই শরৎ ঋতুর চিরচেনা বৈশিষ্ট্য।
এবার গ্রীষ্মের তাপপ্রবাহের কথা ভুলে যাইনি। কী দহনকাল যে কাটিয়েছি আমরা! বর্ষায় এবার অবিরাম বর্ষণ ততটা দেখা যায়নি। তবে আর্দ্রতার অস্বস্তি তো ছিলই।
‘এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলি-বিছানো পথে। এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ-কিরণ-রথে।’ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম শুধু শিউলি ফুলের বন্দনা করলেও শরৎ ঋতুতে বসে হরেক ফুলের মেলা। শরৎকালের আনন্দ বাড়িয়ে দিতে আরও ফোটে বেলি, দোলনচাঁপা, বকুল, শালুক, পদ্ম, জুঁই, কেয়া, কাশফুল, মাধবী, মল্লিকা, মালতী।
এর বাইরে গ্রীষ্মের ফুল হিসেবে পরিচিত কৃষ্ণচূড়া এখনো ফুটে আছে ঢের। মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁও, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশ, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, জাতীয় সংসদ ভবন এলাকা, হাতিরঝিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে কৃষ্ণচূড়া ও সোনালুর উপচানো হাসি দেখা গেল যথেষ্ট।
ভাদ্র ও আশ্বিন—শরতের দুই মাসের আবার দুই রকম চেহারা। কখনো ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি, কখনো অসহনীয় গরম নিয়ে আসে ভাদ্র। আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস অবশ্য বলছে, মঙ্গলবার পর্যন্ত তাপমাত্রা কমে আবার বাড়তে থাকবে।
কোথাও কোথাও এই ভাদ্র মাস ‘তালপাকা ভাদ্র’ নামে পরিচিত। পাকা তাল অবশ্য বাজারে উঠে গেছে। শুরু হয়ে যাবে তালের পিঠা বানানোর আয়োজন।
শরতের দ্বিতীয় মাস আশ্বিনে রাত আসে তাড়াতাড়ি। শীতল হতে থাকে আবহাওয়া। শোনা যায় হেমন্তের পদধ্বনি।
শহরের মানুষদের অনেকেই অনেক রকম লোকাচারের সঙ্গে পরিচিত নন। এই বাংলাদেশে এমনই এক লোকাচারের নাম ‘ভাদর কাটানির উৎসব’। ভাদ্র মাসের প্রথম তিন থেকে সাত দিন নববধূ যদি স্বামীর মুখ দেখেন, তবে অমঙ্গল হতে পারে—এমন বিশ্বাস থেকে শ্রাবণ মাসের শেষ দিকে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়ি চলে যান নববধূরা। এ দেশে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে এই উৎসব উত্তরবঙ্গের দিকে বেশি হয়, দক্ষিণবঙ্গ বা অন্যান্য স্থানে ততটা নয়। প্রথম আলোর পঞ্চগড় প্রতিনিধি রাজিউর রহমান বলছিলেন, একসময় নববধূরা গরু-মহিষের গাড়িতে চড়ে ভাদর কাটানির উৎসবে বাবার বাড়ি নায়র যেতেন। এখন যান মাইক্রোবাস, ইজিবাইকে করে।
এই উৎসবের উৎপত্তি সম্পর্কে জানা যায়, ভাদ্র মাসজুড়ে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান, পুরুলিয়া, মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে ভাদু নামক লৌকিক দেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এর সঙ্গেও বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে প্রচলিত এই উৎসবের সম্পর্ক থাকতে পারে।
শরতে শিউলির মিষ্টি সুবাস যেন দেবী দুর্গার আগমনকে ইঙ্গিত দিতে থাকে। এবার শারদীয় দুর্গাপূজা আসছে ভিন্ন এক পটভূমিতে। বেশ কিছু স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের স্থাপনায় দুর্বৃত্তদের হামলার সাক্ষী হয়েছে এই আগস্ট মাস। অসুর বধ হোক, পূর্ণোদ্যমে ফিরুক বাংলার অন্যতম বৃহত্তম এ ধর্মীয় উৎসব।
রাজধানীতে কয়েক বছর ধরে কাশফুলের সান্নিধ্য লাভের সুযোগ তৈরি হয়েছে উত্তরার দিয়াবাড়িতে। বেলা শেষের নরম আলোয় বাতাস সেখানে মৃদঙ্গ বাজায়। বহু নগরবাসী বেড়াতে যান সেখানে। মিরপুর বেড়িবাঁধ, কেরানীগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জের মাওয়ার দিকে গেলেও কাশফুলের নরম ছোঁয়া পাওয়া যায়। যাওয়া যেতে পারে শাপলাফোটা মুন্সিগঞ্জের আড়িয়ল বিলেও। তবে উন্নয়নের বিভ্রমে দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির আনন্দ, হ্রাস পাচ্ছে নাবাল জমি, কাশফুলের খেত কেটে নিতে হাত কাঁপছে না কারও।
এই শরৎ থাকবে না। প্রকৃতির নিয়মে এসেছে, প্রকৃতির নিয়মেই চলে যাবে। আফসোস করার আগে একটু হৃদয় মেলে শরৎকে দেখা যেতে পারে। এই উতাল হাওয়ায় কি অপরূপ সেজেগুজে রয়েছে শরৎ–রানি! তাতে মনমন্দির খুশি হবে ক্ষণিকের জন্য হলেও।