স্ত্রী পাতি চড়ুই, বরিশাল থেকে
স্ত্রী পাতি চড়ুই, বরিশাল থেকে

চড়ুইয়ের কত রূপ 

‘কত দিন তোমাদের ভোরের উঠানে

দু-একটা খই আর মুড়কির ঘ্রাণে

উড়ে আসি চুপে

দেখি কোনো রূপে

চাল ডাল ছোলা ক্ষুদ খুঁজে পাই কিনা।’

—জীবনানন্দ দাশ


পুরো পৃথিবীর কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশের মতো এত পাখি–আবিষ্ট কবি কম আছেন, আমার কাছে তা–ই মনে হয়। জীবনানন্দের কবিতা ও উপন্যাস মোটামুটি পড়েছি। তাঁর সাহিত্যকর্মে উল্লেখ করা পাখি নিয়ে দুটি বই লিখেছি। প্রথমটি বাংলার এবং জীবনানন্দের শালিকেরা এবং দ্বিতীয়টি জীবনানন্দের পাখিরা। 

কিন্তু তাঁর কবিতায় গ্রামবাংলার অতি চেনা সাতভাওলা বা ছাতারে পাখিটি আসেনি, এটা ভেবে কখনো বিস্মিত হয়েছি! বরিশালে পাখিটি ক্যাচকেইচ্চা নামে পরিচিত। সাতভাওলারা দলে থাকে এবং খুব কর্কশ সুরে ক্যাচক্যাচ করে ডাকে। কবির মনে হয়, সে দৃশ্য চোখে পড়েনি। অথচ কাক তাঁর কবিতায় কতটা প্রবলভাবে এসেছে!

পাখি জীবনানন্দ দাশের প্রায় প্রতিটি কবিতায় এসেছে। কবি ‘পাখি’ শিরোনামেই লিখেছেন কিছু কবিতা। তাঁর প্রতিটি কাব্যগ্রন্থের কবিতা পড়লে তাঁর কাব্যজগতের পাখিবিষয়ক পরিপূর্ণ ধারণা পাওয়া যায়। তিনি ১৫টি কবিতা লিখেছেন পাখির নাম দিয়ে। যেমন দোয়েল, কোকিল, হাঁস, শকুন, প্যাঁচা, ডাহুক, চিল, শালিক, পায়রা, ঘুঘু, বুনো হাঁস, বলাকা, মাছরাঙা, চাতক ও সারস। তাছাড়া কিছু কবিতায় কোনো কোনো প্রজাতির পাখির কথা গভীরভাবে বহুবার এসেছে। এ কবিতাগুলোর মধ্যে ‘কত দিন ঘাসে আর মাঠে’ কবিতাটি আমাদের চড়ুই পাখিকেন্দ্রিক। কবিতাটির পরতে পরতে আছে চড়ুই পাখির ভাবনা ও কাজকর্ম—তারা কী খায়, কীভাবে লাফিয়ে চলে, কোথায় বাসা করে ইত্যাদি।

চড়ুই আমাদের ঘরের কাছের এক ফুর্তিবাজ, অমায়িক ও ভদ্র পাখি। মানুষের গৃহে বাসা বাঁধে, তাদের ফেলে দেওয়া খাবার খায় এবং খুব সহজেই মানুষের বন্ধু বনে যায়। সারা পৃথিবীর শহরগুলোতে চড়ুই দেখা যায়। মানুষের সঙ্গে চড়ুইয়ের একটি মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। হতে পারে ছোট্ট এ পাখির কিচিরমিচির ডাকাডাকি, জোড়পায়ে লাফানো মানুষের ভালো লাগে। আমরা কাক দেখলেই তাড়িয়ে দিই; কিন্তু চড়ুই কিংবা শালিকদের মোটেও তাড়িয়ে দিই না। 

গেছো চড়ুই, হবিগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে

বাংলাদেশে দুই প্রজাতির চড়ুই বাস করে। পাতি চড়ুই ও গেছো চড়ুই। পাতি চড়ুই আমাদের গৃহের বাসিন্দা। অপর দিকে গেছো চড়ুই ঝোপঝাড়ের বাসিন্দা হলেও তারা এখন দেশের রংপুর ও সিলেট বিভাগের বাড়িঘরে, রেলস্টেশনে নিয়মিত বসবাস করছে। ইউরোপ ও বাংলাদেশের চড়ুই পাখি নিয়ে একটি গবেষণা করে এই ফলাফল পেয়েছি। গবেষণাটি ইন্ডিয়ান বার্ড জার্নাল–এ প্রকাশিত হয়।

 প্রজনন মৌসুমে পাতি চড়ুই খড়কুটো, কাঠি, শুকনা ঘাস ও পালক দিয়ে মানুষের ঘরে বাসা বানায়। গ্রামের ঘরের টিনের মটকার কোণে বাসা বাঁধে। শহরের বিল্ডিংয়ের ভেন্টিলেটর বা পাইপের ফাঁকফোকরেও পাতি চড়ুইয়ের বাসা দেখা যায়। পাতি চড়ুইকে কবুতরের খোপে ও খড়ের পালায় বাসা বাঁধতে দেখেছি।

গেছো চড়ুই প্রথমে দেখি ২০০৯ সালে সিলেটের জকিগঞ্জে। তারপর জাফলং, টেকেরঘাট, হবিগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জে গিয়ে কয়েকবারই ১০–১৫টি গেছো চড়ুইয়ের দেখা পেয়েছি। গেছো চড়ুই ঘাসের মধ্যে পোকামাকড় খুঁজে বেড়ায় এবং জোড়পায়ে লাফিয়ে চলে। গ্রাম, মাঠ, ঝোপজঙ্গল, নদীর ধারের মাঠে থাকে। ঝোপালো গাছে, পরিত্যক্ত দালানের ভেন্টিলেটরে বাসা করে মার্চ থেকে আগস্ট মাসে। পাতি চড়ুই থেকে গেছো চড়ুই আলাদা করতে পারা একটু মুশকিল। আলাদা করার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হলো মাথা ও মুকুটের দিকে নজর দেওয়া। গেছো চড়ুই পুরুষ ও স্ত্রী পাখি দেখতে একই রকম। মাথা, ঘাড় ও পুরো মুকুটের পালকের রং চকলেট বাদামি।