প্রায় দেড় দশক আগের কথা। নিসর্গী ও বিজ্ঞান লেখক অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা লন্ডন থেকে নিয়ে আসা বার্ড অব প্যারাডাইস ফুলের একটি চারা বাংলাদেশ শিশু একাডেমির বাগানে রোপণ করেন। কিছুদিন অপেক্ষার পর ফুল ফুটল গাছে। এই আনন্দের খবর তাঁকে জানালাম। তিনি ছুটে এলেন দেখতে। ঘটা করে ছবি তোলা হলো। সেই প্রথম বার্ড অব প্যারাডাইস ফুল দেখা হলো। তবে গাছ ও ফুল আকারে কিছুটা ছোট ছিল। তাতে কী, ফুলটা তো চেনা হলো। কন্দজ এই উদ্ভিদ ফুল দেওয়ার পর মরেও গেল। এরপর দেশে আর কোথাও ফুলটি চোখে পড়েনি। তবে কারও ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকাও অসম্ভব কিছু নয়। এ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। কিন্তু গোলমাল শুরু হলো আরও কিছুদিন পর। কেউ কেউ হ্যালিকোনিয়া নামের একটি ফুলকে বার্ড অব প্যারাডাইস নাম দিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করল। অথচ এই ফুলের সঙ্গে বার্ড অব প্যারাডাইসের কোনো সাদৃশ্যই নেই। ফুল দুটির রং এবং গড়নও একেবারেই আলাদা। অসাধু গাছ ব্যবসায়ীরা সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে হ্যালিকোনিয়া গাছটি বার্ড অব প্যারাডাইস বলে বিক্রি করছে। আদতে আমাদের দেশে বার্ড অব প্যারাডাইস দেখা যায় না। এ গাছের চারা সহজলভ্য নয়, পরিচর্যা সহজসাধ্য নয় বলে কেউ লাগাতেও উৎসাহী হন না।
বার্ড অব প্যারাডাইস মূলত শীতপ্রধান দেশের ফুল। দেখেছি ইউরোপ ও আমেরিকায়। গাছ ও ফুল আকারে বেশ বড়। ফুলের শোভা মনোমুগ্ধকর। কিন্তু হ্যালিকোনিয়া আমাদের দেশে স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে ওঠে। প্রায় সারা দেশে বিভিন্ন পার্ক, উদ্যান ও ব্যক্তিগত সংগ্রহে দেখা যায়। গাছ দুটি সম্পর্কে বিভ্রান্তি দূর করার জন্য পৃথক পরিচিতি আবশ্যক। এই পরিচিতি থেকে গাছগুলো সঠিকভাবে শনাক্ত করতে আমাদের সুবিধা হবে।
মূলত ভুল নামের আড়ালে হারিয়ে যাওয়া হেলিকোনিয়া প্রজাতির এই ফুল আমাদের দেশে এরই মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ইংরেজি নাম হ্যাংগিং লবস্টার ক্লো। জন্মস্থান আমাদের দেশ না হলেও এখানকার প্রকৃতিতে অভিযোজনা চমৎকার। তা ছাড়া ফুলের সৌন্দর্যও মনোমুগ্ধকর। এ কারণেই ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। এ অঞ্চলের ফুল না হওয়ায় কোনো বাংলা নাম নেই। আর সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে নার্সারির কিছু গাছ বিক্রেতা।
হেলিকোনিয়া (Heliconia Rostrata) ক্রান্তীয় আমেরিকার প্রজাতি। গাছ প্রায় চার মিটার পর্যন্ত উঁচু ও খাড়া হয়। পাতা কলাগাছের পাতার মতো, লম্বা ডাঁটার আগায় আয়তাকার ফলক থাকে। মঞ্জরি-ঢাকনা বড়, নৌকার মতো; লাল, আগা সবুজ। ঝুলন্ত মঞ্জরির এই ফুল লাল ও হলুদ রঙে চিত্রিত। ফুল অনেক দিন সতেজ থাকে। বর্ণবৈচিত্র্য তৈরিতে সব বাগানের জন্য আদর্শ। কম পরিচর্যায় বৈরী আবহাওয়ায় ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারে। ফুলের মধু হামিংবার্ডসহ অনেক পাখির প্রিয়। এটি বলিভিয়ার জাতীয় ফুল। সেখানকার স্থানীয় নাম ‘পাটুজু’।
বার্ড অব প্যারাডাইস (Strelitzia Reginae) চিরসবুজ বর্ষজীবী বা দ্বিবর্ষজীবী উদ্ভিদ। আদি আবাস দক্ষিণ আফ্রিকা। ১৭৭৩ সালের দিকে লন্ডনের ‘কিউ’ বোটানিক্যাল গার্ডেনের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে এবং আলংকারিক উদ্ভিদ হিসেবে অতি অল্প সময়ের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা ও ক্যালিফোর্নিয়ায় এ ফুল সবচেয়ে বেশি চাষ হতে দেখা যায়। এটি লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের অফিশিয়াল ফুল। এটি বার্ড অব প্যারাডাইস ছাড়া ক্রেইন ফ্লাওয়ার নামেও পরিচিত। কন্দজ উদ্ভিদ, অনেকটা কলাগাছের মতো, পাতার বোঁটার কোল থেকে মঞ্জরি বেরোয়, তাতে ক্রমেই ফুল ফোটে, গাঢ়-কমলা রং, তাতে আছে নীল পরাগকেশর—খুবই নজরকাড়া। এগুলো আদর্শ কাট-ফ্লাওয়ারও। অর্থাৎ ডাঁটাসহ ফুল কেটে পানিতে ভিজিয়ে রাখলে অনেক দিন সতেজ থাকে। গোড়ার মোথাকন্দ ভাগ করে বা বীজ থেকে চাষ করা হয়। সাধারণত সানবার্ড-জাতীয় পাখিই এ ফুলের পরাগায়ন করে।
চাষের জন্য নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া সর্বোত্তম। অতিরিক্ত তুষারপাত ক্ষতিকর বলে শীতের দেশগুলোতে কাচঘর বা নেট হাউসে রাখা হয়। প্রধান প্রস্ফুটনকাল শীত এবং প্রাক্-বসন্ত। ইদানীং বাগানগুলোতে নতুন অনেক আবাদি জাত শোভা পাচ্ছে।
মোকারম হোসেন, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক