বন্য প্রাণী, পাখি ও প্রজাপতি দর্শনের জন্য ছয়জনের দলে ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩-এ রওনা হলাম হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের উদ্দেশে। সফরের তৃতীয় দিন, অর্থাৎ ১৫ ডিসেম্বর সকালে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল থেকে জুড়ী উপজেলার সাগরনাল বন বিট ও চা–বাগানের উদ্দেশে গাড়ি ছাড়লাম। সকাল সোয়া নয়টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম ওখানে। এরপর চা–বাগান থেকে সিকি কিলোমিটার দূরের সাগরনাল বন বিটের নাম না জানা এক পাহাড়ে উঠতে থাকলাম। কিন্তু পায়ে সমস্যা থাকায় অন্যদের তুলনায় বেশ পিছিয়ে পড়লাম। আর তাতেই হলো লাভ।
বছরখানেক আগে এই পাহাড়ের এক শতবর্ষী প্রাচীন পাকুড়গাছে একটি স্তন্যপায়ী বন্য প্রাণী ও দুটি পাখি এবং পাশের একটি ছোট্ট গাছে আরও একটি পাখি জীবনে প্রথমবারের জন্য দেখেছিলাম। এবারও নিশ্চয়ই নতুন কিছু পাব? এ কথা চিন্তা করতে করতেই পাহাড়ের একেবারে ওপরে উঠে গেলাম।
আমাদের কয়েক গজ সামনে একটি বড় পাতাওয়ালা নাম না জানা গাছ। হঠাৎ আমার অনুসন্ধিৎসু চোখ সেই গাছের পাতার ওপরে বসে থাকা এক পতঙ্গের ওপর আটকে গেল। না, এর আগে এটিকে কখনো দেখিনি। দ্রুত ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রাখলাম। পতঙ্গটি ফোকাস হতেই পটাপট শাটারে ক্লিক করে গেলাম। সঙ্গে থাকা বন্য প্রাণী গাইড সাতছড়ির রাসেল দেববর্মাকে বললাম, ‘রাসেল, নতুন কিছু মনে হচ্ছে, দ্রুত ছবি তোলো।’ সফর শেষে ঢাকায় এসে রাজ্যের কাজে ডুবে পড়লাম, তাই ছবিগুলো নিয়ে বসতে পারলাম না। কিন্তু কদিন পরে ফেসবুকে পোস্ট করে জানতে পারলাম, অতি বিরল এক প্রজাপতির ছবি তুলেছি, যা এর আগে মাত্র দু–তিনজন ব্যক্তি দেখেছেন।
সূত্রমতে, আলম নামের এক ব্যক্তি প্রথম চট্টগ্রামে পতঙ্গটিকে দেখেন। টরবেন বি লারসেন রচিত বাটারফ্লাইজ ইন বাংলাদেশ, অ্যান অ্যানোটেটেড চেকলিস্ট বইয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে অন্য সময়ের চেয়ে মার্চ-এপ্রিলে এটি সচরাচর দেখা যায়, যদিও হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়ায় তেমন একটা চোখে পড়ে না। তবে বাঁশঝাড়ের আশপাশে বাস করা ও একই দলের অন্য প্রজাতিগুলোর সঙ্গে চেহারায় বেশ মিল থাকায় অনেকেই হয়তো এটিকে চিনতে ভুল করে থাকেন। যাহোক, ২০১৯ সালের মার্চে পাখি ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক সৌরভ মাহমুদ বান্দরবানের সাঙ্গু-মাতামুহুরী সংরক্ষিত বনাঞ্চলে পতঙ্গটির দেখা পান। প্রায় পৌনে পাঁচ বছর পর সাগরনালে আমি এর দেখা পেলাম।
অতি বিরল যে পতঙ্গটির গল্প বললাম, সে হলো এ দেশের এক সংকটাপন্ন প্রজাপতি। ইংরেজি নাম ব্ল্যাক ফরেস্টার। কোনো বাংলা নেই, তাই ফরেস্টার বা বনপাল দলের নামের অনুকরণে কৃষ্ণ বনপাল বলা যায়। নিম্ফালিডি গোত্রের স্যাটিরিনি উপগোত্রের প্রজাপতিটির বৈজ্ঞানিক নাম Lethe vindhya। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমারে দেখা যায়।
কৃষ্ণ বনপাল মাঝারি আকারের প্রজাপতি। প্রসারিত ডানার দৈর্ঘ্য ৬৫ থেকে ৭০ মিলিমিটার। নাম কালো হলেও দেহ ও ডানার রং কিন্তু কালো নয়, বরং গাঢ় বাদামি। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। উভয় লিঙ্গেরই ডানা গোলাকার; পেছনের ডানার চতুর্থ শিরা বরাবর একটি করে ছোট লেজ থাকে। সামনের ডানার পক্ষমূল ও মাঝ-আঁচল বরাবর দুটি গাঢ় রেখা চলে গেছে। ডানার ওপর চোখের মতো দেখতে ফুটকিগুলো তুলনামূলকভাবে বড়। পেছনের ডানার ওপরের চোখগুলো ফ্যাকাশে বলয়যুক্ত।
এরা মিশ্র চিরসবুজ পাহাড়ি বনের গহিনে বাস করে। রৌদ্রোজ্জ্বল ও নীরব দিনে ছড়ার পাড় ও বনপথে রোদ পোহাতে দেখা যায়। অন্য সময় বাঁশঝাড়ের ভেতরে বিশ্রাম করে। দ্রুত উড়তে পারে। বয়স্কগুলো ফুলের নির্যাস, গাছের রস, পচা ফল ও স্যাঁতসেঁতে মাটির রস চোষে। জীবনচক্র সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য জানা যায়নি। তবে স্ত্রী প্রজাপতি সচরাচর এক প্রজাতির বাঁশগাছের পাতার নিচের দিকে ডিম পাড়ে বলে জানা যায়।
বিভিন্ন ধরনের গাছপালা প্রজাপতির বংশবৃদ্ধি ও খাদ্যের উৎস। কাজেই এ দেশের প্রজাপতিবৈচিত্র্য রক্ষার জন্য নির্বিচার যেমন গাছ কাটা যাবে না, তেমনি বেশি বেশি দেশি গাছগাছড়া লাগাতে হবে। এতে প্রজাপতিবৈচিত্র্য রক্ষা পাওয়ার পাশাপাশি একদিকে উষ্ণতা কমবে, অন্যদিকে পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা পাবে।
আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ