বিপন্ন বন্য প্রাণী

সেরো যখন মৌলভীবাজারের বনে

ক্যামেরা ট্র্যাপে সেরো। জুন ২০২২
ছবি: লেখক

গত বছরের বর্ষা। ভালুকের খোঁজে মৌলভীবাজারের এক বুনো ঝিরি ধরে হাঁটছি। বনে অনেক ক্যামেরা ট্র্যাপ বসানো। সন্ধ্যার আগে সব কটির ছবি সংগ্রহ করতে হবে। প্রথম ক্যামেরা ট্র্যাপের কাছে পৌঁছানোর পরপরই শুরু হলো প্রবল বৃষ্টি। ছাতা মাথায় সঙ্গে থাকা ল্যাপটপে ছবিগুলো নিচ্ছে সঙ্গী হারিস ও জাফর।

বড় গাছের নিচে একটু দূরে কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছি। পাশেই গাছের মাথায় ভালুকের একটি পুরোনো বাসা ও আরেকটি গাছে নখের দাগ থাকলেও ক্যামেরায় ভালুক আসেনি। মন খারাপ। সব গুছিয়ে বৃষ্টি থামার জন্য অপেক্ষা করছি। একটি অদ্ভুত ধরনের হরিণের ছবি নাকি পাওয়া গেছে।

শুনেই আবার ল্যাপটপ খুললাম। ছবি দেখে হৃৎস্পন্দন বন্ধ হওয়ার দশা। ক্যামেরার খুব কাছ দিয়ে একটি খুরযুক্ত প্রাণী গেছে। শুধু ছোট, চোখা ও কালো এক জোড়া শিং। সঙ্গে লালচে শরীরের অল্পই দেখা যাচ্ছে। শিঙে গোল গোল আংটির মতো সারি। আর খুরগুলো বেশ বড়। এ যে ‘সেরো’!

নতুন উদ্যমে দ্রুতই অন্য ক্যামেরা ট্র্যাপগুলোর কাছে গেলাম। আরেক ক্যামেরা ট্র্যাপে বিশালাকায় এক পুরুষ সেরোর ছবি পেলাম। সিলেট-মৌলভীবাজারের মিশ্র চিরসবুজ বনে ২০১৪ সালে একটি সেরোর শাবক উদ্ধারের খবর জানা গেলেও ক্যামেরা ট্র্যাপ থেকে প্রাপ্ত এটিই প্রথম তথ্য।

সহজ বাংলায় বনছাগল বলা হলেও আদতে প্রাণীটির প্রজাতিতাত্ত্বিক উৎপত্তির ইতিহাস বেশ জটিল, প্রকৃত বুনো ছাগল যেমন আইবেক্স, মারখোরদের চেয়ে একেবারেই আলাদা। তাই এগুলোকে সেরো নামেই ডাকা ভালো। সেরোর নিবাস বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি মিশ্র চিরসবুজ ও ঝরনাযুক্ত বনে।

দিনে চলাফেরা করার নজির থাকলেও অসম্ভব লাজুক, সতর্ক, দ্রুতগামী ও প্রচণ্ড শক্তিশালী সেরোর দেখা পাওয়া দুষ্কর। নাকের ডগা থেকে লেজ পর্যন্ত প্রাণীটি ১৭০ সেন্টিমিটার হতে পারে। কাঁধ পর্যন্ত উচ্চতা ৯৫ সেন্টিমিটার।

পুরুষ সেরো প্রায় ১২০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। ২০১৫ সালে আইইউসিএন বাংলাদেশের মূল্যায়ন অনুযায়ী সেরো বাংলাদেশে বিপন্ন, বিশ্বব্যাপী সংকটাপন্ন। বাংলাদেশে দুই ধরনের সেরো থাকতে পারে, লাল সেরো আর ইন্দো–চায়নিজ সেরো। তবে এ নিয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন।

এ দেশে সেরোর গল্প কম মানুষই জানেন। ২০১৫ সালে রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক সুপ্রিয় চাকমার গবেষণায় কাসালং ও সাঙ্গু-মাতামুহুরী সংরক্ষিত বনে সেরোর উপস্থিতির কথা জানা যায়। পরবর্তী সময়ে ২০১৭ সালে, ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্সের সমীক্ষায় সাঙ্গু-মাতামুহুরী সংরক্ষিত বনে আবারও সেরোর অস্তিত্বের খোঁজ পাওয়া যায়।

এ ছাড়া এ সময়ের সাঙ্গু-মাতামুহুরী সংরক্ষিত বনের নিকটবর্তী লোকালয় থেকে সেরোর শাবক উদ্ধারের অন্তত দুটি খবর প্রথম আলোয় এসেছে। ২০২২ সালের শুরুতে চট্টগ্রামের বারৈয়ারঢালা জাতীয় উদ্যান থেকে ক্যামেরা ট্র্যাপে সেরোর ছবি পেয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোস্তাফা ফিরোজ ও অধ্যাপক কামরুল হাসান।

একাধিক অস্তিত্বের প্রমাণ নির্দেশ করে, বাংলাদেশে এখনো সেরো টিকে আছে। কিন্তু অবৈধ শিকার সেরোর জন্য অন্যতম হুমকি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবিগুলো দেখে অনেকেই যোগাযোগ করলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনপ্রিয় পর্যটনস্থানগুলোয় সেরোর শিং ভালোই বিক্রি হয় বলে জানালেন কেউ কেউ।

মাংসও সহজলভ্য। শিঙের ছবি পাঠালেন বন্য প্রাণী আলোকচিত্রী অরিত্র সাত্তার। সেই একই বন থেকে যেখানে ক্যামেরা ট্র্যাপ করছি। বন্দুকসহ শিকারিরাও ক্যামেরা ট্র্যাপে এসেছে। সেরোগুলো নিয়মিতই শিকার হয়। ঢাকায় ছবিগুলো ভালোমতো দেখে আরও মন খারাপ হলো। পুরুষ সেরোটি বন্দুকের গুলিতে গোড়ালির নিচ থেকে এক পা হারিয়েছে।

সেরো নিয়ে বাংলাদেশে একটিও বৈজ্ঞানিক গবেষণা নেই। যে বনে সেরো আছে, সে বনে চিতা বাঘ, লাম চিতার মতো বড় মাংসাশী প্রাণী থাকবেই। অতি দ্রুত সেরো গণনা করে গুরুত্বপূর্ণ বনগুলো চিহ্নিত করা উচিত। ২০০৯ সালের পর পাহাড়ি বনে একটিও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করা হয়নি। বিশেষত, উত্তর–পূর্ব বাংলাদেশে সেরো-ভালুকের বনগুলোকে নতুন সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা এখন জরুরি।

  • মুনতাসির আকাশ, সহকারী অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়