রুদ্রাক্ষ নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক পৌরাণিক কাহিনি। দেবতা শিবের এক নাম রুদ্র, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অক্ষ, যার অর্থ চোখ। দুর্বিনীত ত্রিপুরাসুরকে বধ করতে গিয়ে শিব দীর্ঘদিন অপলক চোখে যুদ্ধ করার কারণে তাঁর অবসাদগ্রস্ত চোখ থেকে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে এক ফোঁটা অশ্রু। সেই অশ্রুবিন্দু থেকে জন্ম হয় একটি গাছের, যার নাম হয় রুদ্রাক্ষ। সেই গাছে যে ফল হয়, তার বীজ মহাপবিত্র, শিব-পূজারিরা সেই বীজের মালা গেঁথে গলা, বাজু ও বাহুতে পরেন।
বাউল সাধকেরাও পরেন রুদ্রাক্ষ। জ্যোতিষীদের কাছেও রুদ্রাক্ষের কদর রয়েছে। রুদ্রাক্ষের লাল, কালো, হলুদ, ধূসর—নানা রঙের সঙ্গে জ্যোতিষীরা বিভিন্ন গ্রহ–নক্ষত্রের প্রভাব খুঁজে বেড়ান, যদিও এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। ভারতের উত্তরাখন্ডের হৃষিকেশে গিয়ে বহু দোকানে অজস্র রুদ্রাক্ষের মালা বেচতে দেখেছি। এত রুদ্রাক্ষের উৎপাদন কোথায় হচ্ছে, কৌতূহল হয় জানার। দোকানিরা সে সন্ধান দিতে ব্যর্থ হন। অধিকাংশ বিক্রেতা দাবি করেন, তাঁদের মালা আসল রুদ্রাক্ষের। তার মানে এখন কারখানায় কৃত্রিম রুদ্রাক্ষ উৎপাদন হচ্ছে, যা কোনো গাছের প্রকৃত বীজ নয়।
রুদ্রাক্ষগাছের প্রথম দর্শন পেয়েছিলাম সাভারে বিরুলিয়ার এক নার্সারিতে। সেখান থেকে একটি চারা সংগ্রহ করে গত বছর টাঙ্গাইলের সখীপুরে কবি নজরুল পার্কে লাগানো হয়। ছোট হলেও সে গাছে তখন কুঁড়ি ও ফুল এসেছিল ফেব্রুয়ারি মাসে। রুদ্রাক্ষগাছ দেখতে কিছুটা বকুল বা জলপাইগাছের মতো, পাতাও দেখতে অনেকটা তেমন। চওড়া পাতাওয়ালা চিরসবুজ বৃক্ষ, জলপাই বা বকুলের মতো ফুলের কুঁড়ি হয় থোকায় থোকায়, নতমুখে থাকে কুঁড়ি ও ফুল। ফুলের রং হালকা ঘিয়া-সাদা, ফুল দেখতে অনেকটা জলপাই ফুলের মতো। পরিণত বা গাছ বড় হলে তার গোড়ায় শিমুলগাছের মতো অধিমূল জন্মে। ফল দেখতে গাঢ় নীল রঙের, এ জন্য এর ইংরেজি নাম ব্লুবেরি বিডস। উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Elaeocarpus granitrus, পরিবার ইলিওকার্পেসি। ফলের খোসা ছাড়ালে পাওয়া যায় বরইয়ের বীজের মতো বহুমুখী অমসৃণ শক্ত বীজ বা রুদ্রাক্ষ গোটা। বীজ একসঙ্গে জোড়া থাকায় তা এক মিথের জন্ম দিয়েছে। হিন্দুদের অনেকেই এ বীজকে শিব ও পার্বতীর প্রতীক বলে মনে করেন। এ জন্য কোনো কোনো রুদ্রাক্ষকে বলা হয় গৌরীশঙ্কর রুদ্রাক্ষ। ফল খাওয়া যায়, স্বাদে টক বলে নেপালের মানুষ এ থেকে আচার তৈরি করেন। বীজ থেকে চারা হয়। প্রাচীনকালে বসন্ত গুটির ওপর এর প্রলেপ দেওয়া হতো।
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি রুদ্রাক্ষ পাওয়া যায় ইন্দোনেশিয়ার জাভা, সুমাত্রা ও বোর্নিও দ্বীপে এবং নেপালের ভোজপুর জেলায়। ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলে বিশেষ করে উত্তর কাশী, গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী ইত্যাদি এলাকার হিমালয়ের জঙ্গলে এ গাছ দেখা যায়। ঢাকার নিকুঞ্জ থেকে উদ্ভিদপ্রেমী বেনুবর্ণা অধিকারী জানিয়েছেন, নিকুঞ্জ ১ নম্বর গেট দিয়ে ঢুকে ঝিলের পাড়ে একটি রুদ্রাক্ষগাছ রয়েছে। প্রায় পাঁচ ফুট লম্বা সে গাছে ফুল-ফল ধরছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে গত বছর একটি রুদ্রাক্ষগাছের চারা রোপণ করেন উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান। ফরিদপুর হর্টিকালচার সেন্টারে ২০১৭ সালে একটি রুদ্রাক্ষগাছের চারা লাগিয়েছিলেন সে সময়ের সেন্টারের উপপরিচালক কার্তিক চন্দ্র চক্রবর্তী। পরের বছর মে মাসে সে গাছে থোকা ধরে ফুল ফোটে। তিনি বলেন, প্রথম দিকে গাছ বেশ দ্রুত বেড়েছিল, পরে বৃদ্ধি হচ্ছে ধীরে।
রুদ্রাক্ষের নাম জড়িয়ে রয়েছে বাংলা সাহিত্যের অনেক স্থানে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বিলাসী’ গল্পের দরিদ্র সাপুড়ে মৃত্যুঞ্জয়ের গলায় ছিল রুদ্রাক্ষের মালা। কবি নজরুলের গানেও রয়েছে রুদ্রাক্ষের কঠিন রূপ, বিরহপোড়া প্রেমিকের আর্তনাদ ও শিবের মতো অবসাদগ্রস্ততা—‘সখী আমার কঠিন এ রূপ হবে রুদ্রাক্ষেরই মালা/ তার মালা হয়ে ভুলব আমার পোড়া প্রাণের জ্বালা’।