ঝুলি বাদুড়। সম্প্রতি সুন্দরবন থেকে তোলা
ঝুলি বাদুড়। সম্প্রতি সুন্দরবন থেকে তোলা

বন্য প্রাণী

সুন্দরবনের বিরল ঝুলি বাদুড়

চাঁদপাই থেকে করমজল ইকোট্যুরিজম সেন্টারের দিকে যখন রওনা হই, তখন পুব আকাশে ভোরের আলো ফুটছে। গত বছরের মার্চ মাসের শেষ দিক। শীতের আমেজ নেই তেমন একটা। ভোরের সূর্য পেছনে ফেলে আমাদের বোট ‘আলোরকোল’ করমজলের দিকে ছুটে চলছে। পশুর নদে ততক্ষণে তীব্র ভাটা শুরু হয়েছে। ফলে বোটের গতি কিছুটা মন্থর। দুই পাশের বড় বড় জাহাজ ফেলে আমরা পশ্চিমের সুন্দরবন ঘেঁষে পশুর নদ ধরে এগিয়ে চলেছি। যেতে যেতে বেশ কিছু রামগদি চোখে পড়ল নদের খাঁড়িতে। একটু পরে দেখা মিলল সুন্দরবনের বিরল মায়া হরিণের। এখনো পূর্ণ বয়সে পৌঁছায়নি মনে হলো।

ঘণ্টাখানেক পর আমাদের বোট করমজলের জেটিতে ভিড়ল। পর্যটকবাহী দু–একটি বোট করমজলে এসে পৌঁছাতে শুরু করেছে। সেখানে দায়িত্বরত বনকর্মীদের সঙ্গে আলাপ সেরে পুব দিকের হাঁটার ট্রেইল ধরে এগোতে থাকি। চারপাশে পাখির কলকাকলিতে বনের ঘুম ভাঙতে শুরু করেছে। মৌটুসি ও ফুলঝুরি পাখিরাই বেশি। ছোট্ট এই পাখিরা কীটপতঙ্গের খোঁজে এক ডাল থেকে আরেক ডালে বিরামহীন ছুটে চলছে। তাদের কোনো ক্লান্তি নেই যেন। কাঠঠোকরা ও সহেলি পাখিরাও বসে নেই। করমজলের চারপাশে বৈচিত্র্যময় গাছের উপস্থিতিতে নানা জাতের পাখির জন্য এ এলাকা যেন স্বর্গ। এটি পাখিদের এক মিলনমেলা। পাখিদের ছবি তুলতে তুলতে ঘণ্টাখানেক কেটে গেল। একসময় পশ্চিম পাশের ট্রেইল ধরে নেমে এলাম কুমির ও হরিণের বেষ্টনী ফেলে বন অফিসের সামনে।

হরিণের বেষ্টনীসংলগ্ন পাশাপাশি দুটি পুকুরে সুন্দরবনের লোনাপানির কুমির আছে। তাই পর্যটকদের নিরাপত্তার স্বার্থে পুকুরপাড়জুড়ে আছে উঁচু বেষ্টনী। বেশ কিছু নারকেলগাছ আছে পুকুরপাড়ে, আর আছে লম্বা লম্বা ঘাসজাতীয় উদ্ভিদ। পর্যটকদের আনাগোনা ইতিমধ্যে বেশ বেড়েছে। তাই পর্যটক এড়িয়ে পূর্ব দিকের পুকুরের পাড় ধরে দক্ষিণের সরু রাস্তা ধরলাম। এ রাস্তায় পর্যটকদের যাতায়াত নেই। তা ছাড়া পাশের বন থেকে গাছের ডালপালা রাস্তাটিকে প্রায় ঢেকে ফেলেছে। অন্য পাশে হরিণের বেষ্টনী। ফলে রাস্তা ধরে হাঁটা কিছুটা কঠিন। কিছু দূর এগোলেই পুকুরপাড়ের উঁচু দেয়াল। এ পাশে ঘাসগুলোও বেশ লম্বা। ফলে পুকুরের দিকে দৃষ্টি খুব একটা যায় না। জায়গাটি যেহেতু উঁচু, ফলে সুন্দরবনের গোখরা কিংবা রাজ গোখরার ভালো আস্তানা মনে হলো। তাই সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে।

পুকুরের কোনা থেকে কয়েক গজ সামনে এগোনোর পর একটি নারকেলগাছে দৃষ্টি আটকে গেল। গাছের মাঝবরাবর কাণ্ডে ছোট একটি বাদুড়ের মতো কী যেন ঝুলে আছে। বিপরীত দিকে তখন সূর্য। ফলে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। একটি নারকেলপাতা ঝুলে আছে গাছের উল্টো দিকে। বাতাসে কিছুটা দুলছে। ফলে মাঝেমধ্যে ছবি তোলার সুযোগ আসছে। কিন্তু জুতসই দাঁড়াতে পারছি না। কোনোরকমে কয়েকটি ছবি তুলে ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে দেখে ধারণা সত্যি হলো। বেশ ছোট আকারের একটি বাদুড় নারকেলগাছের বাকলের সঙ্গে ছোট্ট নখর আটকে ঝুলে আছে। আমার উপস্থিতিতে তার মধ্যে কিছুটা প্রাণের সঞ্চার হলো। একটু নড়ে উঠল। কিন্তু পরিষ্কার ছবি তুলতে পারছিলাম না। পুকুরের দেয়াল টপকে ভেতরের দিক থেকে যে ছবি তুলব, সেটিও বেশ বিপজ্জনক। শিকার ভেবে যেকোনো সময় কুমির এসে আক্রমণ করতে পারে। আমার দুই গবেষণা সহকারীকে ফোনে ডেকে আনলাম বোট থেকে। ওরা আমাকে ধরে কায়দা করে উঁচু দেয়ালে বসিয়ে দিল। ফলে বেশ কিছু ছবি তুলতে সক্ষম হলাম।

সুন্দরবনে দেখা এই প্রাণীর নাম ঝুলি বাদুড়। ইংরেজি নাম পাউচড ব্যাট। কালচে দেখতে। একা কিংবা জোড়ায় থাকতে পছন্দ করে। এর ঊর্ধ্ববাহু গড়ে ৬৪ মিলিমিটার লম্বা হয়। লেজের দুই পাশে কোনো চামড়ার আবরণ থাকে না। এদের সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য এখনো বিজ্ঞানীরা জানতে পারেননি। ধারণা করা হয়, এদের প্রধান খাদ্য ছোট ছোট কীটপতঙ্গ। সারা দিন বিশ্রাম ও ঘুমিয়ে কাটায় নির্জন কোনো গাছের বাকলে কিংবা কাণ্ডে ঝুলে। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে কীটপতঙ্গের খোঁজে।

এশিয়ার বেশ কিছু দেশসহ অস্ট্রেলিয়ায় এই বাদুড়ের দেখা মেলে। আমাদের দেশে মধুপুরের শালবন ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এটি দেখা গেছে। ২০২২ সালে লাঠিটিলা বনের একটি পাকুড়গাছের বাকলের ফোকরে এই বাদুড়ের সন্ধান পাই আমরা। আইইউসিএনের লাল তালিকায় এটি ডেটা ডেফিশিয়েন্ট বা তথ্যহীন প্রজাতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত। সুন্দরবনে এই বাদুড়ের এটিই প্রথম রেকর্ড।

  • এম এ আজিজ: অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়