রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে চট্টগ্রাম নগরের আট এলাকায় এবং কক্সবাজার ও তিন পার্বত্য জেলায় চলছে পাহাড় কাটা।
বায়েজিদ চন্দ্রনগর কলাবাগান এলাকায় প্রায় এক মাস ধরে থেমে থেমে পাহাড় কাটা চলছিল। ২০২৩ সালেও একই এলাকায় পাহাড় কাটা হয়েছিল। তখন মামলা হয়। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর আবার শুরু হয় পাহাড় কাটা। ১৩ আগস্ট এলাকাটি পরিদর্শন করে পরিবেশ অধিদপ্তর পাহাড় কাটার প্রমাণ পায়। এ নিয়ে বায়েজিদ থানায় চারজনকে আসামি করে মামলা হয়েছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও পুলিশের এ বিষয়ে নজর ছিল না। এ সুযোগে নির্বিচার পাহাড় কাটা শুরু করেন স্থানীয় লোকজন। আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করে চট্টগ্রাম মহানগরের অন্তত আটটি এলাকায় এখনো পাহাড় কাটা চলছে। নগরের বায়েজিদ থানাধীন তিনটি স্থানে ও আকবরশাহ থানা এলাকায় পাহাড় বেশি কাটা হচ্ছে। এর বাইরে কক্সবাজার ও তিন পার্বত্য জেলায়ও পাহাড় কাটা চলছে।
নগরে পাহাড় চিহ্নিত করে সাইনবোর্ড টানানোর কথা থাকলেও তা পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। প্রশাসন মামলা ও জরিমানা করে পাহাড় কাটা রোধে চেষ্টা করে গেলেও তা কার্যকর নয়। পরিবেশের মামলায় বেশির ভাগই অর্থদণ্ডে নিষ্পত্তি হয়। এটিও পাহাড় কাটা বন্ধ না হওয়ার অন্যতম কারণ মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
পাহাড় কাটা রোধে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) দীর্ঘদিন ধরে আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টি করে চলেছে। এক–দুই মাস ধরে নতুন করে পাহাড় কাটার বিষয়টি তাদেরও নজরে এসেছে। বেলা চট্টগ্রামের সমন্বয়ক মনিরা পারভীন জানান, কিছুদিন ধরে চট্টগ্রাম নগরের আকবরশাহ, পাহাড়তলী, বায়েজিদ, জঙ্গল সলিমপুর, জঙ্গল লতিফপুর, খুলশী, লালখান বাজার, আসকারদীঘিসহ বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় কাটা চলছে। আন্দোলনের সুযোগ কাজে লাগিয়ে এসব পাহাড় কাটা হয়।
গত বুধবার দুপুরে সরেজমিনে জঙ্গল সলিমপুর আরেফিন নগর এলাকায় দেখা যায়, পাহাড় কেটে সড়ক তৈরির পাশাপাশি জায়গা দখলে নেওয়া হচ্ছে। পাহাড়ের কাটা অংশে কলাগাছ লাগিয়ে দেওয়া হয়। এ সড়ক ধরে জঙ্গল সলিমপুর যেতে হয়। সড়কের প্রশস্ততা বাড়ানোর পাশাপাশি সীমানা ঘেরাও দিচ্ছিলেন দুই শ্রমিক। তাঁরা জানান, মালিকের নির্দেশে তাঁরা এ কাজ করছেন।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের পরিচালক হিল্লোল বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়েকটি জায়গায় পাহাড় কাটার খবর পেয়েছি। এর মধ্যে দুটি মামলাও হয়েছে। বাকিগুলোর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’ নগরের পাশাপাশি অন্যান্য জেলায় পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় বলে দাবি করেন তিনি।
চন্দ্রনগর এলাকায় পাহাড় কাটার ঘটনায় ১৩ আগস্ট অধিদপ্তরের টেকনিশিয়ান মো. ওমর ফারুক বাদী হয়ে বায়েজিদ থানায় মামলা
করেন। মামলার আসামিরা হলেন সৈয়দ মুহাম্মদ রকিবুল আলম, এস এম মনজুরুল আলম, এরশাদুল আলম ও মো. আরিফ। প্রথম তিনজন আপন ভাই।
কয়েকটি জায়গায় পাহাড় কাটার খবর পেয়েছি। এর মধ্যে দুটি মামলাও হয়েছে। বাকিগুলোর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।হিল্লোল বিশ্বাস, পরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম
চট্টগ্রামে ২০১১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৫৬০টি পাহাড় কাটার অভিযান পরিচালনা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এসব অভিযানে ৮৫ কোটি ২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম মহানগরে চলতি বছরে পাহাড় কাটার অভিযোগে পরিবেশ অধিদপ্তর পাঁচটি মামলা করেছে। আগের বছর মামলা হয় ১০টি। ২০২২ সালে মামলা হয়েছিল ২২টি। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার চন্দ্রনগর এলাকায় পাহাড় কাটার অপরাধে মামলা হয়েছে বায়েজিদ থানায়।
আকবরশাহ এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতা ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিমের বিরুদ্ধে পাহাড় কাটার মামলা রয়েছে চারটি।
বৃহত্তর চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি পাহাড় কাটা হয়েছে কক্সবাজার এলাকায়। এ পর্যন্ত এখানে পাহাড় কাটার জন্য ১৮১টি মামলা করা হয়েছে।
এর মধ্যে ১১৫টিতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ৬৬টি মামলার তদন্ত চলছে। চট্টগ্রাম জেলা, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে মোট মামলা
হয়েছে ৬০টি। এর মধ্যে ৫২টির অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। এ ছাড়া বান্দরবানে ২১টি ও কুমিল্লায় পাহাড় কাটার অপরাধে ৯টি মামলা হয়েছে। গত দুই মাসেও এসব এলাকায় পাহাড় কাটার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বেলা চট্টগ্রাম বিভাগের পাঁচটি জেলা যথাক্রমে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনসহ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলাগুলোতে সব পাহাড় কাটা বন্ধে ২০১১ সালে একটি জনস্বার্থমূলক মামলা (নম্বর ৭৬১৬/২০১১) করে। ২০১২ সালের ১৯ মার্চ আদালত এসব জেলার পাহাড় কাটা বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করেন।
বেলার অপর একটি জনস্বার্থমূলক মামলায় (৭৮৮৩/২০১৫) আদালত চট্টগ্রাম নগরের আকবরশাহ থানার অধীন উত্তর পাহাড়তলী মৌজার ১৭৮, ১৭৯ ও ১৮০ নম্বর বিএস দাগগুলোয় অবস্থিত পাহাড় কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেন।