৩০ আগস্ট হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে এসব পাখি জব্দ করা হয়। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে ১ কোটি ৬২ লাখ টাকা জরিমানা।
সাইপ্রাস থেকে ৩৬টি পাখি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসছে। উড়োজাহাজে বিশেষ ধরনের খাঁচায় ভরে আনা হচ্ছে এসব পাখি। বিমানবন্দরে অবতরণের আগেই কাস্টমস কর্মকর্তারা জানতে পারেন, এই চালানে বিশ্বে বিক্রিনিষিদ্ধ পাখি রয়েছে। বিমানবন্দরে অবতরণের পর জব্দ করা হয় সব পাখি। পরে জানা গেল, এসব পাখির মধ্যে ৩১টিই বিশ্বজুড়ে বিক্রিনিষিদ্ধ।
গত ৩০ আগস্ট হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসব পাখি জব্দ করা হয়। একেকটি পাখির দাম গড়ে ১০ লাখ টাকা বলে জানা গেছে। নিয়ম অনুযায়ী বন বিভাগের কাছে হস্তান্তরের কথা থাকলেও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ জাতীয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের কাছে এসব পাখি তুলে দিয়েছে। এ নিয়ে দুই পক্ষে চলছে টানাটানি।
কাস্টমস সূত্রে জানা যায়, সাইপ্রাস থেকে এসব পাখি আমদানি করেছে কাসভি এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তারা বন বিভাগ এবং প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের অধীন দেশের চিড়িয়াখানাগুলোতে পাখি ও বন্য প্রাণী সরবরাহ করে থাকে। রাজধানীর আশুলিয়ায় তাদের পাখির খামারও আছে।
কাস্টমস কর্তৃপক্ষ আমাদের পাখিগুলোকে কোয়ারেন্টিনে রাখতে দিয়েছে। এরপর তারা যে সিদ্ধান্ত দেবে, আমরা তা মেনে নেব।মাহফুজুল হক, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, জাতীয় চিড়িয়াখানা
তাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে কেবল পাঁচটি পাখি আমদানির অনাপত্তিপত্র দেখাতে পেরেছে। বাকি ৩১টি পাখি অবৈধ হিসেবে জব্দ করে কাস্টমস। অবৈধভাবে আমদানি ও শুল্ক ফাঁকির অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটিকে ১ কোটি ৬২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কাস্টম হাউসের কমিশনার এ কে এম নুরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব পাখি অবৈধভাবে আনা হচ্ছে বলে আমরা আগেই খবর পেয়েছি। এর সঙ্গে কোনো আন্তর্জাতিক চক্র যুক্ত কি না, তা-ও আমরা খতিয়ে দেখছি।’
এ ব্যাপারে জানতে কাসভি এন্টারপ্রাইজের কর্মকর্তা টিসমার খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি এখন মোটরসাইকেলে আছি। এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারব না।’
পরে টিসমার খানের মুঠোফোনে কয়েক দফা চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোনো জবাব দেননি।
কাস্টমস কর্তৃপক্ষের তালিকা অনুযায়ী, জব্দ করা পাখিগুলোর মধ্যে রয়েছে গোল্ডেন প্যারাকিট, ব্লু থ্রোটেড ম্যাকাও, স্কারলেট ম্যাকাও, মিলিটারি ম্যাকাও, রুবালিনা ম্যাকাও, রেড অ্যান্ড গ্রিন ম্যাকাও। এই ৩১টি পাখির বাজারমূল্য প্রায় তিন কোটি টাকা।
কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাইপ্রাস থেকে পাখিগুলো অবৈধভাবে উড়োজাহাজে তোলা হয়েছে। পুরো ঘটনায় একটি আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্র জড়িত। দেশেও ওই চক্রের সদস্যরা সক্রিয়। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে এসব পাখি অন্য কোনো দেশে পাচার করা হচ্ছিল। এর আগেও বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে এমন চালান আটক করা হয়েছে।
বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, এ ধরনের বন্য প্রাণী আটক হলে তা বন বিভাগের কাছে তুলে দেওয়ার কথা। কিন্তু কাস্টমস কর্মকর্তারা এসব পাখি জাতীয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের জিম্মায় দিয়েছেন। এর আগে গত মে মাসে চারটি ম্যাকাও পাখি আটক করেছিল বন বিভাগ ও কাস্টমস। সেগুলো নিয়ম অনুযায়ী বন বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
নিয়ম অনুযায়ী বিদেশ থেকে কোনো জীবন্ত প্রাণী আনা হলে তা কমপক্ষে ২১ দিন কোয়ারেন্টিনে রাখতে হয়। কোয়ারেন্টিনে পাখিগুলো জাতীয় চিড়িয়াখানায় রাখা হয়েছে।
জানতে চাইলে বন বিভাগের বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইন অনুযায়ী পাখিগুলো বন বিভাগের কাছে দেওয়ার কথা। কেন তারা সেটা করল না, তা জানতে চেয়ে আমরা কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দেব।’
বন্য প্রাণী আমদানির নিয়ম অনুযায়ী, বিদেশ থেকে বন্য প্রাণী আনতে হলে প্রথমে বন বিভাগের অনাপত্তিপত্র লাগে। অনাপত্তিপত্র দেওয়ার আগে তারা বিষয়টি যাচাই-বাছাই করে। পরে আমদানি প্রাণী এলে আবার বন বিভাগের একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সেগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখেন। সংস্থাটির কর্মকর্তা ওই প্রাণী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইনে আমদানিনিষিদ্ধ কি না, তা নিশ্চিত করেন। অনাপত্তিপত্র অনুযায়ী প্রাণী এসেছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা নিশ্চিত করলে কাস্টমস কর্মকর্তারা নিয়ম অনুযায়ী ছাড় দেন।
জানা যায়, সাইপ্রাস থেকে এই ৩৬টি পাখি আসার পর বন বিভাগের এক জুনিয়র কর্মকর্তা গিয়ে প্রথমে ওই সব পাখি ছাড় করা যায় বলে মতামত দেন। কিন্তু কাস্টমসের কর্মকর্তারা আবার বন বিভাগের কাছে যাচাই-বাছাইয়ের অনুরোধ করেন এবং বিষয়টি বন বিভাগের শীর্ষ পর্যায়ে জানান।
পরে ২ সেপ্টেম্বর বন বিভাগ ও কাস্টমসের কর্মকর্তারা আবার পাখিগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। এবার তাঁরা নিশ্চিত হন, ৩৬টি পাখির মধ্যে ৩১টি বিশ্বজুড়ে আমদানিনিষিদ্ধ। বন্য প্রাণী পাচার রোধবিষয়ক বৈশ্বিক সংস্থা সাইটসে এসব পাখি তালিকাভুক্ত।
এসব পাখি কোথাও পাওয়া গেলে তা জব্দ করে পাচারে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে সংস্থাটি। বাংলাদেশ ওই সংস্থার সদস্য। বাংলাদেশের বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনেও ওই প্রজাতির পাখি কেনাবেচা এবং পরিবহননিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে জাতীয় চিড়িয়াখানার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাহফুজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাস্টমস কর্তৃপক্ষ আমাদের পাখিগুলোকে কোয়ারেন্টিনে রাখতে দিয়েছে। এরপর তারা যে সিদ্ধান্ত দেবে, আমরা তা মেনে নেব।’