পরিবেশ রক্ষায় অনেক আইন, নীতি ও পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু সেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে মুষ্টিমেয় একটি গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। সরকারি উদ্যোগ যে দায়সারা ভাবে, গা–ছাড়া ভাবে চলছে, তা পরিবেশ–সংকটকে মারাত্মক বিপর্যয়কর করে তুলেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের চেষ্টা করতে চলতি বছরকেই ‘ঘুরে দাঁড়ানোর বছর’ হিসেবে ঘোষণা করে কার্যক্রম গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)।
আজ বুধবার সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে বাপা ‘স্থায়িত্বশীল নগরায়ণে পরিবেশের গুরুত্ব’ শীর্ষক আলোচনার আয়োজন করে। এতে বলা হয়, রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের পরিবেশের চিত্র তুলে ধরে পরিবেশের সংকট মোকাবিলায় সরকার, সংশ্লিষ্ট, মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ সবাইকে বারবার তাগিদ দেওয়া হবে। পরিবেশসংক্রান্ত আইন ও নীতিমালা বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পরিবেশবিদ ও অংশীজনদের নিয়ে তাঁদের কাছে যাওয়া হবে। কথা বলা হবে। কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এসব উদ্যোগকেই ‘ঘুরে দাঁড়ানো’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন বাপার পরিবেশবিদেরা। তাঁরা বলেছেন, সরকারি উদ্যোগ যে দায়সারা ভাবে, গা–ছাড়া ভাবে চলছে, তা পরিবেশ–সংকটকে মারাত্মক বিপর্যয়কর করে তুলেছে। এভাবে আর চলতে পারে না।
বাপার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মহিদুল ইসলাম খানের সভাপতিত্বে এই সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ পড়েন বাপার সহসভাপতি স্থপতি ইকবাল হাবিব। এর আগে বাপা চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি বিশেষজ্ঞ ও অংশীজনদের নিয়ে ‘স্থায়িত্বশীল নগরায়ণ: সমস্যা ও সমাধান’ শীর্ষক দিনব্যাপী এক সম্মেলনের আয়োজন করে। সেই সম্মেলনে যেসব পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ উঠে এসেছিল, সেগুলো পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। এই পুস্তিকার সারসংক্ষেপ নিয়েই মূল প্রবন্ধ রচনা করা হয়েছিল। অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে এই পুস্তিকার মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
প্রবন্ধে বলা হয়, দেশে নগরায়ণ সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে ২ দশমিক ৬ শতাংশ হারে বন উজাড় হয়েছে, যা বৈশ্বিক হারের চেয়ে দ্বিগুণ। ‘রাইজিং টাইডস, রোরিং ফিউচার্স: দ্য সুন্দরবনস কোয়েস্ট ফর সারভাইভাল-২০২৪’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৭৩ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত সুন্দরবনে ঘন বনাঞ্চাল কমেছে ২৭ ভাগ। যেকোনো শহরে ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা উচিত। কিন্তু ঢাকায় আছে ৮ শতাংশের কম। বুয়েটের নগর অঞ্চল ও পরিকল্পনা বিভাগ এবং ইউএসএইডের জরিপে এসেছে ২০০২ থেকে ২০২২ পর্যন্ত ঢাকায় সবুজ হারিয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ।
ইকবাল হাবিব প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, ২০১০ সালের ড্যাপে (ঢাকা মহানগর বিষদ পরিকল্পনা) ৩৮ দশমিক ৫৬ ভাগ এলাকা কৃষিজমি হিসেবে সংরক্ষিত থাকলেও নতুন ড্যাপে (২০২২-২০৩৫) তা কমিয়ে ২৮ দশমিক ৮ শতাংশ করা হয়েছে। একইভাবে ‘প্লাবনভূমি এলাকা’ হিসেবে চিহ্নিত ৬৬ শতাংশ এলাকার ৫৩ শতাংশই শর্ত সাপেক্ষে উন্নয়নের আওতায় আনা হয়েছে। এই শর্তের সুযোগ দিয়ে কিছুসংখ্যক ভূমিদস্যু, জবরদখলকারী ও আবাসন ব্যবসায়ীকে নিম্ন এলাকা ভরাট করে আবাসন ব্যবসার পথ করে দেওয়া হয়েছে। গত বছর বাংলাদেশে ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের গবেষণায় দেখা গেছে, এই ভূমিদস্যুরা গত ২৮ বছরে ঢাকার ৮৫ শতাংশ জলাভূমি ভরাট করে ফেলেছে। নির্মাণ স্থাপনা বৃদ্ধি পাওয়ায় ৭৫ ভাগ গাছপালা ধ্বংস হয়ে গেছে। ইদানীং আবার শুরু হয়েছে উন্নয়নের নামে সড়কের পাশের ছায়াদানকারী গাছপালা কেটে ফুলের গাছ লাগানোর প্রক্রিয়া। যার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ স্থাপন করেছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সাত মসজিদ রোডে। এখানে তারা জনগণের প্রবল প্রতিরোধের মুখেও পড়লেও জনমত উপেক্ষা করা হয়েছে।
মূল প্রবন্ধে রাজধানীর বায়ুদূষণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জলবায়ুর পরিবর্তনে তাপপ্রবাহে বিভিন্ন স্থানে ‘তাপদ্বীপ’ সৃষ্টি হওয়ার মতো পরিবেশ বিপর্যয়কর বিষয় ও তার প্রভাব তুলে ধরে প্রতিকারের জন্য ছয় দফা সুপারিশ করা হয়।
এসব সুপারিশের মধ্য রয়েছে নগর এলাকাসহ সব সড়ক-মহাসড়কের পাশের বৃক্ষশুমারি করে ডেটাবেজ তৈরি করে উন্নয়নে অজুহাত দিয়ে এসব গাছ কাটা নিয়ন্ত্রণ করা। বন ও বনভূমি রক্ষায় সংশ্লিষ্ট সবার জবাবদিহির আওতায় আনা। ‘সবুজায়ন নীতিমালা’র ভিত্তিতে নগর বন সৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। ক্রমেই কমে আসা কৃষিজমির সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। নগরে বিদ্যমান খাল, জলাশয়গুলো পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ নিশ্চিত করে ‘নীল আন্তসংযোগ’ গড়ে তুলতে হবে। এ ছাড়া পরিবেশ রক্ষায় সমীক্ষানির্ভর নীতিমালা প্রণয়ন করে তা কার্যকর করার অবদানের জন্য প্রণোদনা ও লঙ্ঘনের জন্য কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়।
আলোচনায় আরও অংশ নেন নগরের পানিদূষণ এবং পুকুর জলাশয় নিয়ে আলোচনা করেন বুয়েটের অধ্যাপক ইশরাত জাহান। বায়ু ও শব্দদূষণ নিয়ে আলোচনা করেন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার, নগরের পরিবেশ নিয়ে বলেন বাপার যুগ্ম সম্পাদক মিহির বিশ্বাস। সঞ্চালনা করেন বাপার সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির।