গবেষণার তথ্য

‘তাপীয় দ্বীপ’ হয়ে উঠছে ঢাকা

একটু স্বস্তির জন্য মুখে পানি দিচ্ছেন তিনি। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

দাবদাহের কারণে প্রচণ্ড গরমে বেশ কিছুদিন খুব অস্বস্তিতে ছিল ঢাকাবাসী। কিন্তু সে সময় ঢাকার চারপাশে সবুজ এলাকায় গরমের অনুভূতি কম ছিল। গবেষকেরা বলছেন, ঢাকার সঙ্গে শহরের বাইরের গরমের অনুভূতির এই পার্থক্যের মূলে রয়েছে তাপীয় দ্বীপ (হিট আইল্যান্ড)। ঢাকার মূল বসতি ও বাণিজ্যিক এলাকার একটা বড় অংশ তাপীয় দ্বীপে পরিণত হয়েছে। ফলে ঢাকার ঠিক বাইরের প্রাকৃতিক পরিবেশসমৃদ্ধ এলাকার সঙ্গে রাজধানীর তাপের পার্থক্য তৈরি হয়েছে। ভূপৃষ্ঠীয় তাপের এই পার্থক্য সর্বোচ্চ ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

গত বছর স্প্রিনজার নেচারের থিওরেটিক্যাল অ্যান্ড অ্যাপ্লাইড ক্লাইমেটোলজি সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণায় ঢাকা শহরে তাপীয় দ্বীপের প্রভাবের এসব তথ্য উঠে এসেছে।

‘নগরায়ণে পরিবর্তন ও ঢাকা শহরে তাপীয় দ্বীপের প্রভাব’ শীর্ষক এই গবেষণায় বলা হয়, ঢাকার উষ্ণতম স্থানের সঙ্গে শহরের বাইরের শীতলতম স্থানের দিন-রাতের ভূপৃষ্ঠীয় তাপমাত্রার পার্থক্য যথাক্রমে ৭ ও ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিষয়টি অনেকটা এমন, ঢাকার অদূরে সাভার বা মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে যখন তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকছে, তখন রাজধানীর তেজগাঁও-ফার্মগেট এলাকার ভূপৃষ্ঠীয় তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবার ঢাকার ভেতরেও ভূপৃষ্ঠীয় তাপমাত্রার পার্থক্য দেখা যায়। যেমন দিনের সবচেয়ে উত্তপ্ত সময়ে মিরপুরের চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেন এলাকার তাপমাত্রা গুলশানের চেয়ে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম।

গবেষণাটি করেছেন ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি মালয়েশিয়ার সহযোগী অধ্যাপক শামসুদ্দিন শাহিদ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী মোহাম্মদ কামরুজ্জামান, আহ্‌ছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর কৌশল বিভাগের শিক্ষক এ এস এম শাহনেওয়াজ উদ্দিন, বালুচিস্তানের লাসবেলা ইউনিভার্সিটি অব অ্যাগ্রিকালচার ওয়াটার অ্যান্ড মেরিন সায়েন্সেসের শিক্ষক নাজিবুল্লাহ খান ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের আবু রেজা মো. তৌফিকুল ইসলাম। গবেষণায় নেতৃত্ব দেওয়া শামসুদ্দিন শাহিদ গতকাল রোববার বলেন, গত কয়েক যুগ ধরে ঢাকা শহরে তাপমাত্রা দ্রুত বাড়তে দেখা যাচ্ছে। অন্তত শহরের ফুটপাতের পাশে ও ভবনের ছাদে গাছ লাগালে এবং আবর্জনাস্থলে পরিণত হতে চলা জলাভূমিগুলো ফিরিয়ে আনা গেলে তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি কমিয়ে আনা সম্ভব।

গবেষণা দলের সদস্য মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, ঢাকার একটা বড় অংশ তাপীয় দ্বীপে পরিণত হয়েছে। এসব এলাকার ফুটপাত, উন্মুক্ত স্থানে গাছ লাগাতে হবে। বাড়ির ছাদে বাগান করতে হবে। এ ছাড়া শহরে জলাভূমি সৃষ্টি করতে হবে।

ঢাকার সবচেয়ে উত্তপ্ত এলাকায় (তাপীয় দ্বীপ) পরিণত হয়েছে তেজগাঁও, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, পল্টন, মতিঝিল, গুলশান, বনানী, রামপুরা, বনশ্রী, মাদানী অ্যাভিনিউ। এরপরই আছে উত্তরা, মিরপুর, শেওড়াপাড়া।

গবেষণায় দেখা যায়, ২০০১ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ঢাকা শহরের ভূপৃষ্ঠ এলাকা ২৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ সম্প্রসারিত হয়েছে। একই সময়ে জনসংখ্যা বেড়েছে ৭৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ।

কামরুজ্জামান বলেন, ঢাকার ভূপৃষ্ঠ এলাকা সম্প্রসারণের মানে হলো, শহরের সবুজ স্থান ও জলাভূমি কমে গেছে। শহরে বেড়েছে মানুষ ও বসতি। জনসংখ্যা-জনবসতি বেড়ে যাওয়াসহ অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে মাত্র দেড় যুগের বেশি সময়ে ঢাকার কিছু এলাকার গড় তাপমাত্রা শহর সীমানার তুলনায় ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। বিশেষ করে মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে; অর্থাৎ গ্রীষ্মকালে ঢাকায় গরমের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি থাকছে।

গবেষণায় বলা হয়, ঢাকা শহরের সবচেয়ে বেশি সম্প্রসারণ হয়েছে ২০০৭ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে। এই সময়ে শহর এলাকা বেড়েছে ৬ দশমিক ১ শতাংশ। ২০০১ সালে ঢাকার প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৯ হাজার ৪৮১ জন বাস করত। ২০১৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ১৩ হাজার।

ইতিমধ্যে ঢাকা শহরে তাপীয় দ্বীপের প্রভাব কমাতে উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। উত্তর সিটির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ঢাকার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য আগামী দুই বছরে দুই লাখ গাছ লাগাব। যুক্তরাষ্ট্রের রকফেলার ফাউন্ডেশন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তায় আমরা শহরের তাপমাত্রা কমানোর জন্য একজন কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছি। আশা করি সবার সহযোগিতায় শহরের তাপমাত্রা কমানো যাবে।’

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ বলছে, ঢাকায় চলতি বছরের এপ্রিলের প্রথম ২৯ দিনের ২৫ দিনই দাবদাহ বয়ে গেছে। আশপাশের জেলাগুলোর তুলনায় ঢাকার তাপমাত্রা সব সময়ই ২ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি থাকতে দেখা গেছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদের নেতৃত্বে চলতি বছরের এপ্রিল মাসের ঢাকার তাপমাত্রা নিয়ে একটি গবেষণা চলছে। গবেষণার প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে, শহরের বেশির ভাগ এলাকায় এপ্রিলের প্রায় পুরো সময় তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ছিল; অর্থাৎ এপ্রিলজুড়ে ঢাকায় প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের কারণে ঢাকার যেসব এলাকা বেশি উত্তপ্ত, সেসব এলাকায় অগ্নিঝুঁকিও তৈরি হচ্ছে।

এ ব্যাপারে সাব্বির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা শহরে অপরিকল্পিত নগরায়ণ হয়েছে। সবুজ-জলাভূমি প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেছে। এতে প্রায় পুরো শহর তাপীয় দ্বীপে পরিণত হয়েছে। ফলে এখানে একটি অসহনীয় পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যা শহরের অধিবাসীদের জন্য খুবই অস্বস্তিকর ও অস্বাস্থ্যকর। শহরের বাতাস পর্যন্ত উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। এই পরিস্থিতিতে সবুজায়ন না ঘটাতে পারলে ঢাকা শহরের অবস্থার আরও অবনতি হবে।