সাত বছর আগের কথা। ভারতের উত্তরাখন্ড রাজ্যের নৈনিতালে এসেছি। শহর থেকে ১২.৫ কিলোমিটার দূরে খুরুপতালের মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে অবস্থিত ডাইন্যাস্টি রিসোর্টে উঠেছি। দুই দিন ধরে এখানকার দর্শনীয় স্থানগুলো দেখে তৃতীয় দিন সকালে হিমালয়ান উদ্ভিদ উদ্যানে গেলাম।
এরপর ইকো কেভ পার্ক দর্শন করে দুপুরে বিখ্যাত শিকারি ও প্রকৃতিবিদ জিম করবেটের জাদুঘরের উদ্দেশে ৩২ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে কালাধুঙ্গি পৌঁছলাম। বহুদিনের জমে থাকা ইচ্ছাটা পূরণ হলো।
জাদুঘর থেকে ৩৪ কিলোমিটার দূরের রামনগরের ক্ল্যারিসা রিসোর্টের দিকে রওনা হলাম করবেট জাতীয় উদ্যান দেখার জন্য। দেলা রোড ধরে এগিয়ে চলেছি। ২৫ কিলোমিটার চলার পর হঠাৎ রাস্তার পাশের বিদ্যুতের তারে এক প্রজাতির বাবুইয়ের উপনিবেশ বাসা চোখে পড়ল; কিন্তু ড্রাইভার গাড়ি থামালেন বেশ দূরে। এদিকে সন্ধ্যাও ঘনিয়ে এসেছে। তাই সহযাত্রীরা আর পেছনে যেতে চাইলেন না। ফলে অতি বিরল বাবুইয়ের বাসার ছবি তোলা হলো না। মনের কষ্ট মনেই রয়ে গেল।
এ জীবনে বাবুইয়ের বাসা কম দেখিনি। এ দেশে ওরা সচরাচর তালগাছে বাসা গড়ে। আমার গ্রাম মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার পুরান বাউশিয়ায় খেজুরগাছেও বাসা দেখেছি। সম্প্রতি আবারও দেখলাম বিরুলিয়ায়। রংপুর শহরের রবার্টসনগঞ্জে সুপারিগাছে বাসা দেখেছি ২০১০ সালে। পরবর্তী সময়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে কণ্টকময় বাবলাগাছে বাবুইয়ের বাসা দেখেছি। রাজশাহীর পদ্মার চরের লম্বা ঘাসের আগায় কালোবুক বাবুইয়ের বাসা দেখেছি ২০১৫ সালে। বর্ষার পাখির খোঁজে ৭ সেপ্টেম্বর কেরানীগঞ্জের কলাতিয়ায় গিয়ে নারকেলগাছে জীবনের প্রথম বাবুইয়ের বাসা দেখলাম।
যাহোক, রুচিসম্মত বাসা বানানো পাখিদের মধ্যে এদেশে বাবুইয়ের স্থানই প্রথম। এদের বাসা তৈরিতে নিপুণ শিল্পীর ছাপ রয়েছে। বাসার সূক্ষ্ম বুনন ও মজবুত গাঁথুনি দেখলেই তা বোঝা যায়। এত সূক্ষ্মভাবে মেপে মেপে ধান, ঘাস ও তাল–খেজুরের পাতা কাটে যে স্থপতিরাও হার মানবেন। তা ছাড়া স্থাপত্যের কোন সূত্রটি নেই সেখানে? আছে সঠিক ও পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা, সুন্দর প্রবেশপথ, দুর্যোগ বা শত্রুর কবল থেকে রক্ষার ব্যবস্থা, একাধিক কুঠুরি, ডিমের ঝুড়ি—সবকিছুই। বাসার নিচের কুঠুরিতে একটু কাদামাটি বা গোবর দিয়ে রাখে, যাতে বাসাটি কিছুটা ভারী হয় ও ঝড়-বাতাসে না উল্টায়। সাপ বা শত্রুর আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য বাসায় দুটি প্রবেশপথ বানায়। ওরা যেটি ব্যবহার করে, সেটি বাইরে থেকে দেখা যায় না।
প্রজননকালে পুরুষ বাবুই ধান, ঘাস ও তাল–খেজুরের পাতার শিরার এক পাশে ঠোঁট চালায়। এরপর ওড়ার জন্য জোরে ডানা ঝাপটায়। গতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পত্রফলকের একাংশ ঠোঁটের সঙ্গে কেটে যায়। দু–তিন ফুট লম্বা পত্রফলক ঠোঁটে চেপে ওড়ার দৃশ্য সত্যিই চমৎকার। এরপর পছন্দের গাছের সরু ডাল বা পত্রধারে সেটি প্যাঁচায়, গিঁট দেয় ও বাসা বুনতে শুরু করে। সুচালো ঠোঁটের সাহায্যে পাতা ফুটো করে সেলাইয়ের মতো ফোঁড়ের পর ফোঁড় দিয়ে যায়। লম্বা টুপির মতো বাসার অর্ধেকটা তৈরি হলেই ঝাঁকে ঝাঁকে স্ত্রী বাবুই আসে।
বরবেশী পুরুষেরা তখন কিচিরমিচির শব্দে প্রেমের গান গেয়ে, ডিগবাজি খেয়ে, বাসা দুলিয়ে প্রেয়সীদের অভ্যর্থনা জানায়। স্ত্রীরা একেকটি বাসায় প্রবেশ করে; খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করে, টেনেটুনে বুনন পরীক্ষা করে। এক বাসা থেকে অন্য বাসায় যায়। পছন্দ হলে সেই বাসার স্থপতিকেই বেছে নেয়।
এরপর পুরুষ বাসার বাকি কাজ শেষ করে। বাসা বানাতে ৭ থেকে ১০ দিন লাগে। ২০১৩ সালে মৌলভীবাজারের ভানুগাছে একটি তালগাছে পুরুষ বাবুইয়ের বাসা বানানো ও স্ত্রী বাবুইয়ের তা পরীক্ষা করার দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বেঁচে থাকুক স্থপতি পাখিগুলো বাংলার বুকে চিরকাল।
আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ