'প্রাণীদের প্রাণ বাঁচাতে চইলা আসি'

করোনাভাইরাসের কারণে বন্ধ জাতীয় চিড়িয়াখানা। কিন্তু চিড়িয়াখানার জলহস্তীগুলোকে দেখাশোনা করতে হয় বন্যপ্রাণী তত্ত্বাবধায়ক নূর আলমকে। প্রতিদিন ১৫ কিলোমিটার পথ হেঁটে, কিছু পথ রিকশায় চড়ে আসেন ৬০ বছর ছুঁই ছুঁই নূর আলম। ছবি : কমল জোহা খান
করোনাভাইরাসের কারণে বন্ধ জাতীয় চিড়িয়াখানা। কিন্তু চিড়িয়াখানার জলহস্তীগুলোকে দেখাশোনা করতে হয় বন্যপ্রাণী তত্ত্বাবধায়ক নূর আলমকে। প্রতিদিন ১৫ কিলোমিটার পথ হেঁটে, কিছু পথ রিকশায় চড়ে আসেন ৬০ বছর ছুঁই ছুঁই নূর আলম। ছবি : কমল জোহা খান

‘৩৭ বছর ধইরা প্রাণী দেখাশোনা করি। এমন চিড়িয়াখানা আমি জীবনেও দেখি নাই। এত নীরব, শান্ত চিড়িয়াখানা কখনো ছিল না। টানা ছুটিও চিড়িয়াখানায় পাই নাই। কিন্তু ঘরে থাকতে পারি না। আমি না আইলে জলহস্তীগুলোরে দেখব কে? ওদের খাওয়াইবো কে? প্রাণ বাঁচাতে প্রাণের টানে চইলা আসি।’ কথাগুলো বলছিলেন মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানার বন্য প্রাণী তত্ত্বাবধায়ক নূর আলম। চিড়িয়াখানায় এখন রয়েছে ১৬টি জলহস্তী। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে গত ২০ মার্চ থেকে চিড়িয়াখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এই প্রাণীদের দেখভাল করতে সাভারে নিজের বাড়ি থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে প্রতিদিন আসছেন নূর।

আজ শনিবার চিড়িয়াখানার জলহস্তীর বেষ্টনীর সামনে দেখা হয় ৬০ বছর ছুঁই ছুঁই নূর আলমের সঙ্গে। চৈত্রের তপ্ত দুপুরবেলায়ও অবুঝ এই বন্য প্রাণীগুলোকে যত্ন-আত্তির কমতি নেই তাঁর। কখনো ভুট্টা, ঘাস, লাউয়ের টুকরো নিয়ে জলহস্তীগুলোর কাছে যাচ্ছেন নূর আলম। তাঁকে দেখেই বড় মুখটি কয়েক ফুট চওড়া করে দিচ্ছে ওরা। খাবার শেষ হলে চৌবাচ্চার পানির ভেতর থেকে মাথা উঁচু করে আবার এক দৃষ্টিতে নূর আলমের দিকে তাকিয়ে থাকে জলহস্তীগুলো।

নূর আলম বলেন, ‘আমি ওদের ছাড়া থাকতে পারি না। বাড়ি থাকলে কেন জানি আমার মনটা কেমন করতে লাগে। মনে হয় আমার দম বন্ধ হইয়া যাইব।’

১৯৮৩ সালে মিরপুরে জাতীয় চিড়িয়াখানায় বন্য প্রাণী তত্ত্বাবধায়কের চাকরি শুরু করেন নূর আলম। তখন তাঁর বয়স ছিল প্রায় ২০ বছর। বছর কয়েক পর আফ্রিকা থেকে আসে দুটি জলহস্তী ডায়না আর টিটো। তখন থেকে জলহস্তী দেখাশোনা করছেন নূর আলম। করোনাভাইরাসের কারণে ১৫দিন ধরে বন্ধ রয়েছে চিড়িয়াখানা। দীর্ঘ চাকরি জীবনে টানা এত দিন চিড়িয়াখানা বন্ধ থাকতে দেখেননি তিনি।

নূর আলম জানান, ২০টিরও বেশি জলহস্তী জন্ম হয়েছে তাঁর সামনে। এখন আগন্তু, জলকন্যা, জলসুন্দরী নামের জলহস্তীগুলো তাঁর কথাতেই ওঠাবসা, খাওয়াদাওয়া করে। চিড়িয়াখানা বন্ধ থাকলেও প্রাণীদের পরিচর্যা করতে হয়। তাই নূর আলমকেও আসতে হয়।

নূর আলম বলেন, ‘আমার বাড়ি সাভারের আশুলিয়ার রুস্তমপুর এলাকায়। চিড়িয়াখানা থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে আমার বাড়ি। করোনার কারণে আসা-যাওয়া করতে খুব কষ্ট হয়। সকাল ছয়টায় বাড়ি থেকে বের হই। কিছু দূর হাঁটি। তারপর বিরুলিয়া ব্রিজ থেকে রিকশা ভাড়া নিয়া মিরপুর বেড়িবাঁধে ইস্টার্ন হাউজিংয়ের সামনে থামি। রিকশা ভাড়া ১০০ টাকা খরচ হয়। এরপর আবার হাঁইটা চিড়িয়াখানায় আসি।’

দর্শনার্থী নেই, নিজেদের মতো সময় পার করছে প্রাণীগুলো। ছবি: কমল জোহা খান

বয়সের ভারে কষ্ট হলেও জলহস্তীদের কাছে দেখলে সব যন্ত্রণা দূর হয়ে যায়। এ কথা জানিয়ে নূর আলম বলেন, ‘আমার কথা ওরা বুঝতে পারে। আমিও ওদের কথা বুঝতে পারি। ওদের মেজাজ-মর্জি সবই ধরতে পারি। কোন জলহস্তী বেশি রেগে আছে, হেইডা ওদের চোখ দেখলে ধরতে পারি। তাই না আইসা কি পারি!’

সাভারের বাড়ি থেকে চিড়িয়াখানায় আসতে প্রায় এক ঘণ্টা সময় চলে যায় নূর আলমের। ৮ ঘণ্টা টানা কাজ করেন তিনি। এই সময় চিড়িয়াখানায় জলহস্তীদের খাওয়া-দাওয়া করান। বাড়তি কাজ হিসেবে বর্তমানে জলহস্তীদের বেষ্টনীর ভেতর বড় পুকুরটি পাকা করা হচ্ছে। কংক্রিটের ঢালাই করা হবে পুকুরের চারধার। এ জন্য ১৬টি জলহস্তীকে তিন ভাগে আলাদা করে ছোট চৌবাচ্চায় রাখা হচ্ছে। গরমের এই সময় ওদের যেন কষ্ট না, সে জন্য পাম্প মেশিন দিয়ে চৌবাচ্চাগুলো পানি দিতে হচ্ছে। এই কাজও নূর আলম করছেন। বিকেল তিনটার দিকে আবার একইভাবে সাভারে নিজের বাড়ির দিকে রওনা হন নূর আলম।

তবে টানা বন্ধ থাকায় চিড়িয়াখানার প্রাণীগুলো বেশ উৎফুল্ল রয়েছে বলে জানান জাতীয় চিড়িয়াখানার কিউরেটর মো. নূরুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মিরপুরে চিড়িয়াখানায় ১৩৭ প্রজাতির ২৭৭৮টি প্রাণী রয়েছে। প্রাণীদের দেখতে দর্শকের চাপ সারা বছরই এখানে থাকে। তাই দেখা যায়, বেশি মানুষ দেখতে পেয়ে প্রাণীরা চুপ করে খাঁচার এককোণে বসে থাকে। চলাফেরাও কম করে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে চিড়িয়াখানা বন্ধ থাকায় প্রাণীরা খাঁচার সামনে আসছে। সকাল না হতেই ডাকাডাকি করছে। খাওয়াদাওয়াও আগের চেয়ে বেশি করছে। বন্ধ থাকলেও বন্য প্রাণীদের পরিচর্যাও করে যেতে হবে।’