উজান থেকে নেমে আসা ঢল ও ভারী বৃষ্টিতে দেশের উত্তর ও উত্তর–পূর্বাঞ্চলের নদ–নদীগুলোতে পানি বাড়ছে। বন্যা পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। এদিকে বোরো ধান কাটা শেষ হলেও বন্যা ও বৃষ্টির কারণে শুকাতে পারেননি কৃষক। সেই ধান কৃষকের গোলায় রয়ে গেছে। বাজার অবধি আসতে পারেনি। সরবরাহ কমে যাওয়ায় ধান-চালের দাম এখন বাড়তির দিকে।
সিলেটের উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে গত দুদিনে চার শ থেকে পাঁচ শ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। আর সুনামগঞ্জে গতকাল শনিবার ২০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এই ভারী বৃষ্টি ঢল হয়ে দেশের হাওর এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটাচ্ছে। এদিকে তিস্তার পানি বেড়ে লালমনিরহাট থেকে নীলফামারী হয়ে রংপুর পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকার নিচু এলাকা ডুবে গেছে। ব্রহ্মপুত্রের পানি বেড়ে কুড়িগ্রাম থেকে মানিকগঞ্জ পর্যন্ত আটটি জেলায় বন্যা ছিল। গত দুদিনে সেই বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। আর দেশের উত্তর ও উত্তর–পূর্বাঞ্চলের বন্যাকবলিত ওই এলাকাগুলো দেশের ‘ধানভান্ডার’ হিসেবে পরিচিত। মাসখানেক আগেই এসব এলাকার প্রধান ফসল বোরো ধান কাটা হয়েছে। কিন্তু ধান কাটার পরপরই বৃষ্টি ও বন্যা শুরু হওয়ায় সেই ধান কৃষকের গোলা আর মজুতদারের গুদাম থেকে হাটে আসতে পারছে না।
চালকলমালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বন্যার কারণে হাটবাজারগুলোতে ধান–চালের সরবরাহ কমে দাম বাড়ছে। অন্যদিকে গোলায় ও গুদামে থাকা প্রায় দেড় কোটি টন ধানের বড় অংশ হচ্ছে ভেজা, যার এক কোটি টন আছে দেশের হাওর ও উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে।
এসব জেলায় শুকানোর জন্য প্রয়োজনীয় রোদ না পাওয়ায় ধানের মান দিন দিন খারাপ হচ্ছে বলে মনে করছেন ধান–চালের ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে বাজারে সরবরাহ কমে আসায় চালের দামও প্রতি সপ্তাহে বাড়ছে। মোটা চালের কেজি ৪৫ টাকায় উঠে আর নামছে না। অন্যদিকে এক সপ্তাহে মাঝারি মানের চালের দামও প্রায় ২ শতাংশ বেড়েছে। ধানের দামও গত এক সপ্তাহে প্রতি মণে ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
এই পরিস্থিতিতে সরকারের দিক থেকে গুদামে ধান সংগ্রহের যে লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে, সেটি যে পূরণ হচ্ছে না, তা ধরেই নেওয়া হয়েছে। খাদ্য অধিদপ্তর থেকে লক্ষ্যমাত্রার সমপরিমাণ চাল কিনে তা যে গুদামে ভরবে, তারও উপায় নেই। কারণ, চালকলমালিকেরা সংগ্রহ মূল্য না বাড়ালে সরকারকে চাল না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আবার মোটা চালের দাম বেশি বেড়ে গেলে খোলাবাজারে চাল বিক্রি শুরু করার নিয়ম আছে। বর্ষার কারণে তা–ও করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বন্যা এসে ধান–চালের বাজারে নতুন চাপ সৃষ্টি করেছে।
>দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি জেলা বন্যাকবলিত
বন্যার কারণে ধান-চালের সরবরাহ কমে দাম বাড়তির দিকে
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম প্রথম আলোকে বলেন, বন্যা পরিস্থিতি সামলানোর মতো যথেষ্ট পরিমাণে চালের মজুত সরকারি গুদামে আছে। তবে বাজারে ধান–চালের দাম কেন বাড়ছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বন্যা পরিস্থিতির কারণে সরবরাহে কিছুটা সমস্যা হতে পারে। তবে পানি নেমে গেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আর দরকার হলে সরকার চাল আমদানির সুযোগ করে দেবে। সেই ঘোষণা তো আগেই দেওয়া হয়েছে।
সাধারণত বোরো ধান কাটার পর তা কৃষক দ্রুত বিক্রি করে দেন। ফলে জুলাই মাসে সাধারণত ধান–চালের দাম কমে আসে। এবার উল্টো ঘটনা ঘটেছে। ধান কাটা শেষ হওয়ার পরপর বৃষ্টি ও বন্যার কারণে জুনের শেষ সপ্তাহ থেকে ধান–চালের দাম বাড়তে শুরু করেছে।
দেশের অন্যতম বড় চালকলের মালিক বেলাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ধান কাটার পর কৃষকেরা ধান শুকানোর জন্য কিছুটা রোদ পান। এবার ধানও একটু দেরিতে কাটা শেষ হয়েছে। আবার বর্ষাও আগেভাগে শুরু হয়েছে। ফলে বেশির ভাগ কৃষক, ব্যবসায়ী ও চালকলমালিকের কাছে থাকা ধান ভেজা। বিশেষ করে কৃষকের কাছে থাকা ভেজা ধানের ৩ থেকে ৫ শতাংশ বৃষ্টি ও বন্যার কারণে নষ্ট হতে পারে।
এদিকে সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, দেশে ধানের অন্যতম বড় ভান্ডার হাওরের জেলাগুলোতে আগামী দুই–তিন দিন বন্যার পানি দ্রুত বাড়বে। ভারতের চেরাপুঞ্জিসহ এই জেলাগুলোতে আগামী এক সপ্তাহ টানা ভারী বৃষ্টি হতে পারে। তবে সেখানকার পানি আগামী চার-পাঁচ দিনের মধ্যে নেমে যাবে। দেশের ধানের আরেক বড় উৎপাদন এলাকা উত্তরাঞ্চলের বন্যার পানি একটু দেরিতে নামবে। মাসের বাকি সময়জুড়ে সেখানে বন্যার পানি থাকতে পারে বলে পূর্বাভাসে বলা হয়েছে।
দেশের ধান–চালের অন্যতম বড় সরবরাহ জেলা নওগাঁ ধান চাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নীরদবরণ সাহা প্রথম আলোকে বলেন, এমনিতেই এ বছর ধানের উৎপাদন কম হয়েছে। তার সঙ্গে বন্যার সমস্যা যোগ হওয়ায় হাটে ধানের সরবরাহ অনেক কমে গেছে। ফলে ধানের দাম দ্রুত বাড়ছে।
বন্যা পরিস্থিতি সম্পর্কে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, আমাগী এক সপ্তাহ বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হবে। বর্তমানে ১৫ জেলায় যে বন্যা আছে, তা ২৫ জেলায় ছড়িয়ে পড়তে পারে।