ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের পরিচালক-আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ এবং শিক্ষক সালিমুল হক। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও দুর্যোগ নিয়ে ২০ ডিসেম্বর প্রথম আলোর সঙ্গে তাঁর কথা হয়।
প্রথম আলো: এক দিকে বন্যা আরেক দিকে পাহাড়ধস। অনেকেই এসবকে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলাফল হিসেবে দেখছেন। আপনি কী বলবেন?
সালিমুল হক: আজকাল আর শুধুই প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে কিছু নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে যেসব ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে তার সিংহভাগ এড়ানো সম্ভব যদি মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে সহযোগিতা করত, দায়িত্বশীল আচরণ করত। আমাদের দায়িত্বজ্ঞানহীন অপরিকল্পিত আয়োজন আমাদেরই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। অবশ্যই জলবায়ু পরিবর্তন ভূমিকা রাখছে। সেসব কারণে নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসছে। আগের চেয়ে বেশি বৃষ্টি, বেশি ঝড় হচ্ছে।
প্রথম আলো: হারিকেন হার্বির প্রকোপে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। ফলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে-এটা তো পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার ব্যর্থতা। যেমনটি ঘটেছে আমাদের চট্টগ্রামসহ নানা শহরে।
সালিমুল হক: এর থেকে এটাই প্রমাণিত হচ্ছে যে আমরা নিজেদের পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার জন্য যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছি না। পানি নামার খাল, নদী বন্ধ করে বাড়িঘর দোকানপাট বসাচ্ছি। পানি সরে যাওয়ার রাস্তা যত সংকুচিত হবে, আমাদের জলাবদ্ধতা তত গভীর আর দীর্ঘায়িত হবে। আমরা আমাদের জলাভূমি বা ওয়েটল্যান্ড রক্ষা করতে পারছি না। ঢাকা-চট্টগ্রামের জলাবন্ধতা একেবারেই আমাদের তৈরি।
প্রথম আলো: আর রাঙামাটির পাহাড়ধস?
সালিমুল হক: পুরোটা না হলেও আমরা অনেকটা দায়ী। অন্তত প্রাণহানি এড়ানো সম্ভব ছিল।
প্রথম আলো: আপনি গত নভেম্বরে জার্মানির বনে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে গিয়েছিলেন। কী অর্জন হলো এবার?
সালিমুল হক: বন সম্মেলন সে রকম কোনো গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন ছিল না। তবে যেহেতু ফিজির (প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপ দেশটি জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে) সভাপতিত্বে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাই ছোট দেশগুলোর আওয়াজটাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
প্রথম আলো: মার্কিন প্রেসিডেন্ট জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচি থেকে নিজেদের প্রত্যাহারের কথা যখন বলেছিলেন, তখন আপনি বলেছিলেন ক্ষতি নেই, বরং ভালোই হবে। আপনি কি এখনো সেটাই বিশ্বাস করেন?
সালিমুল হক: নিশ্চয়ই! ট্রাম্পের সঙ্গে কেউ নেই। বন সম্মেলনে দলে দলে মার্কিন শিক্ষাবিদ, গবেষক, উন্নয়নকর্মী, প্রাইভেট কোম্পানি এসেছিল। তারা ক্রমাগতভাবে একটা কথাই বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তন সারা বিশ্বের জন্য হুমকি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর বাইরে থাকতে পারে না।
প্রথম আলো: ব্যবসায়ীরা কেন এসেছিলেন?
সালিমুল হক: তাঁরা বুঝতে পেরেছেন নবায়নযোগ্য জ্বালানিই ভবিষ্যৎ। বাতাস থেকে, সূর্যের আলো থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ এখন আগের থেকে অনেক সস্তা হয়েছে। এখন উৎপাদিত বিদ্যুৎ মজুত করে রাখারও প্রযুক্তি এসে গেছে। কয়লা আর তেলের চেয়ে আরও সহজ ও সস্তা আর পরিবেশবান্ধব করার জন্য ব্যবসায়ীরা উৎসাহ দেখাচ্ছেন। তাঁরা আর কয়লায় যাবেন না।
প্রথম আলো: কিন্তু আমরা তো কয়লায় যাচ্ছি। শ্রীলঙ্কা যাবে বলেও গেল না, কয়লা বাদ দিল। আমরা কেন যাচ্ছি?
সালিমুল হক: বিরুদ্ধ মতবাদও আছে। আন্দোলন হচ্ছে দেখা যাক।
প্রথম আলো: আপনি কি কোনো আশা দেখছেন?
সালিমুল হক: আমি আশাবাদী এ দেশের সাধারণ মানুষের শক্তি অনেক, তরুণ-তরুণীদেরও পরিবর্তনের শক্তি আর ইচ্ছা দুটোই আছে। এটাই আমাদের পুঁজি। নতুন তরুণ ব্যবসায়ীদের মধ্যেও নতুন আর বড় কিছু করার আগ্রহ আছে। সরকার, গবেষণাপ্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় সবাই মিলে যদি পরিকল্পনামাফিক এই পুঁজি আর শক্তিকে ব্যবহার করা যায়, তাহলে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলা আর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় একটা উদাহরণ হতে পারে। ইতিমধ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার নানা ক্ষেত্রে বিশেষ করে সাইক্লোন ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে, হচ্ছে। কৃষকেরাও উদ্ভাবন করছেন, পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলছেন। এগুলো গবেষণার মাধ্যমে আরও ব্যাপকভিত্তিক করতে হবে।