নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও হালদায় চলছে বালুবাহী বার্জ। সোমবার বিকেলে চট্টগ্রামের রাউজানের নোয়াপাড়া ইউনিয়নের মোকামীপাড়া এলাকায়
নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও হালদায় চলছে বালুবাহী বার্জ। সোমবার বিকেলে চট্টগ্রামের রাউজানের নোয়াপাড়া ইউনিয়নের মোকামীপাড়া এলাকায়

হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য

হালদা রক্ষার নিষেধাজ্ঞা শুধু কাগজেই

■হালদা নদীতে খননযন্ত্র ও ইঞ্জিনচালিত নৌযান ব্যবহার বন্ধের সুপারিশ আমলে নেওয়া হচ্ছে না। বন্ধ হয়নি ইট-বালুর ব্যবসা।

■ ২০২১ সালে হালদা থেকে সাড়ে ৮ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ।

■ ২০২০ সালে ডিমের পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি।

দেশের অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননকেন্দ্র হালদা নদীর মা মাছ ও বিপন্ন গাঙ্গেয় ডলফিন রক্ষায় ইঞ্জিনচালিত নৌযান চলাচল ও খননযন্ত্র দিয়ে বালু তোলায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সেই নিষেধাজ্ঞা এখন কেবল কাগজেই। প্রজনন মৌসুমের (ফেব্রুয়ারি–জুলাই) ছয় মাস ছাড়া বাকি সময় চলাচল করছে বালু ও পাথর বহনকারী বার্জ (পণ্য পরিবহনের নৌযান)। দুই মাস ধরে এসব অনিয়ম আগের অবস্থায় ফিরেছে।

প্রশাসন ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও থেমে নেই ডলফিনের মৃত্যু। গত সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চার মাসের ব্যবধানে নদীর আধা কিলোমিটার (উত্তর মাদার্শার রামদাস মুন্সির হাট থেকে দক্ষিণ মাদার্শার আকবরিয়া এলাকা পর্যন্ত) এলাকায় তিনটি ডলফিন মরে ভেসে ওঠে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ২০১৮ সালের ১১ এপ্রিল হালদা নদীতে খননযন্ত্র ও ইঞ্জিনচালিত নৌযান ব্যবহার বন্ধের পাশাপাশি আরও চারটি সুপারিশ করেছিল। এগুলো হচ্ছে বালু তোলা বন্ধ, নদীতে জালের ব্যবহার নিষিদ্ধ, কলকারখানার বর্জ্য ও দূষিত পানি নদীতে প্রবেশ করতে না পারা এবং নদীতীরের মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি ও ডলফিনের নিরাপদ বিচরণ, প্রজনন ও গবেষণার ব্যবস্থা করা।

জেলা প্রশাসন, মৎস্য অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সংস্থাকে এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এসব সুপারিশ এখন উপেক্ষিত। এতে নদীর জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

রাউজান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জোনায়েদ কবির ও হাটহাজারীর ইউএনও শাহিদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, হালদার জীববৈচিত্র্য রক্ষায় উপজেলা প্রশাসন সব সময় তৎপর থাকে। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে অবৈধ কিছু হলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি সূত্র জানায়, ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের শেষ পর্যন্ত ১০টি মৃত মা মাছ উদ্ধার করা হয়েছে। এসবের মৃত্যু হয়েছে আঘাতের কারণে। তবে এ সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি। সব তাদের কিংবা প্রশাসনের নজরে আসে না।

প্রশাসন ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও থেমে নেই ডলফিনের মৃত্যু। গত সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চার মাসের ব্যবধানে নদীর আধা কিলোমিটার (উত্তর মাদার্শার রামদাস মুন্সির হাট থেকে দক্ষিণ মাদার্শার আকবরিয়া এলাকা পর্যন্ত) এলাকায় তিনটি ডলফিন মরে ভেসে ওঠে। এর মধ্যে সর্বশেষ গত ২৭ ডিসেম্বর নদীর হাটহাজারী অংশের দক্ষিণ মাদার্শা ইউনিয়নের আকবরিয়া এলাকায় একটি মৃত ডলফিন উদ্ধার করে উপজেলা প্রশাসন। এগুলোর শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল বলে জানান গবেষকেরা। এ নিয়ে গত চার বছরে এই নদীতে ডলফিন মারা গেছে ৩৩টি।

হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি সূত্র জানায়, ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের শেষ পর্যন্ত ১০টি মৃত মা মাছ উদ্ধার করা হয়েছে। এসবের মৃত্যু হয়েছে আঘাতের কারণে। তবে এ সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি। সব তাদের কিংবা প্রশাসনের নজরে আসে না।

গত ২৮ ও ২৯ ডিসেম্বর সরেজমিনে দেখা গেছে, হালদা নদীর রাউজান অংশের নোয়াপাড়া ইউনিয়নের কচুখাইন থেকে হাটহাজারীর লাঙ্গলমোড়া পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকায় বালু ও পাথরবাহী বার্জ এবং বড় বড় যান্ত্রিক নৌযান চলাচল করছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) হালদা নদীতীর রক্ষা বাঁধ প্রকল্পের কাজ চলছে। এ প্রকল্পের কাজের জন্য বালু, পাথরসহ বিভিন্ন উপকরণসামগ্রী নেওয়ার কাজে প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০টি বার্জ নদীতে চলাচল করছে।

পাউবোর প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, ২০১৯ সালের শুরু থেকে নদীর ভাঙন থেকে বসতবাড়ি রক্ষায় তীর রক্ষা বাঁধের নির্মাণকাজ চলছে। আগামী ফেব্রুয়ারিতেই বাঁধের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

যোগাযোগ করা হলে পাউবোর চট্টগ্রাম অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বাঁধ রক্ষার কাজের জন্য সাময়িকভাবে নৌযানগুলো চলাচল করছে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে মৌখিক সম্মতি নেওয়া হয়েছে।

নৌযান চলাচলের বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি বলে প্রথম আলোকে জানান চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী। তিনি বলেন, হালদায় সারা বছরই খননযন্ত্র, যান্ত্রিক নৌযান চলাচল সম্পূর্ণ নিষেধ আছে। সরকারি প্রকল্পের কাজে যদি এসব ঢোকে, তাহলে সেটাও বেআইনি। গত ২৭ ডিসেম্বর এ রকম খবর পেয়ে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে নদীতে অভিযান চালিয়ে দুটি খননযন্ত্র জব্দ করা হয়েছে। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, জেলা প্রশাসনের কাছ থেকেও কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি।

বন্ধ হয়নি ইট–বালুর ব্যবসা

বন্ধ হয়নি বালু তোলাও। সরেজমিনে দেখা গেছে, রাউজানের নোয়াপাড়া ইউনিয়নের মোকামী পাড়া গ্রামের পশ্চিম তীরের ছায়ার চর এলাকা থেকে ৩০ থেকে ৪০টি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় বালু তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বিক্রির জন্য। এ ছাড়া রাউজানের নদীর সত্তারঘাট ও হাটহাজারীর আমতুয়া এলাকায়ও বালু তোলা হচ্ছে।

নদীতীরে ইটভাটার ব্যবসাও বন্ধ নেই। রাউজানের উরকিরচর ইউনিয়নের তীর ঘেঁষে চলছে দুটি ইটভাটার কার্যক্রম। এই ভাটাগুলোতে রাতে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় মাটি ও বালু সরবরাহ করা হয়। ইটভাটা দুটি হচ্ছে উরকিরচর ইউনিয়নের দেওয়ানজির ঘাট এলাকার আজমীর অটো ব্রিকস ও একই ইউনিয়নের আবুরখিল গ্রামের শান্তি ব্রিকস। এ ছাড়া চট্টগ্রাম নগরের বর্জ্য ও দূষিত পানি হাটহাজারীর বুড়িশ্চর ইউনিয়নের খন্দকীয়া খাল ও কৃষ্ণ খাল হয়ে হালদায় পড়ছে।

এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে উপজেলা প্রশাসনের অভিযান বলতে কেবল জাল জব্দ। গত এক বছরে ৭৮টি অভিযান চালিয়ে ৮৪ হাজার মিটার জাল জব্দ করে। আর রাউজান উপজেলা প্রশাসন ২০১৯ থেকে ২০২১ পর্যন্ত ৬৮টি অভিযান চালিয়ে জব্দ করে সাড়ে ৬৩ হাজার মিটার জাল। হালদাপারের মানুষকে সচেতন করতেও কোনো উদ্যোগ নেই।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে হালদা রক্ষা কমিটির সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান মনজুরুল কিবরীয়া প্রথম আলোকে বলেন, নদীতে আবার যে হারে বার্জ চলাচল চালু হয়েছে, তাতে ডলফিন মরবেই। কারণ, নদীর জীববৈচিত্র্যের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে বালু তোলা, বালুবাহী বার্জ ও যান্ত্রিক নৌযান চলাচল। নিষেধাজ্ঞার ভেতর সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য এসব চলাচলে তাঁদের সঙ্গে কোনো সমন্বয় হয়নি। সরকারি প্রকল্পের এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে স্থানীয় বালু ব্যবসায়ীরাও আবার নদীতে খননযন্ত্র দিয়ে বালু তোলা শুরু করে দিয়েছেন, যা ক্ষতির কারণ বড় কারণ হয়েছে।

হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির তথ্য অনুযায়ী, গত বছর এ নদী থেকে সাড়ে আট হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়। সেখান থেকে রেণু পাওয়া যায় ১০৫ কেজি। ২০২০ সালে ডিমের পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি এবং রেণুর পরিমাণ ৩৯৪ কেজি। ২০১৯ সালে পাওয়া গিয়েছিল ৬ হাজার ৯৮৭ কেজি ডিম ও রেণু ১৯২ কেজি।

খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলার হালদাছড়া (পাহাড়ি ঝরনা) থেকে হালদা নদীর উৎপত্তি। ৯৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদী চট্টগ্রামের কালুরঘাট এলাকায় কর্ণফুলী নদীতে এসে মিশেছে। এ নদীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি রুইজাতীয় মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজননকেন্দ্র, যেখান থেকে নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়।