বাঁশখালীর খানখানাবাদ উপকূলের প্রেমাশিয়া এলাকার বাসিন্দা ফাতেমা বেগম। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে তিনি হারিয়েছেন চার সন্তানকে। সেই থেকে কোনো ঘূর্ণিঝড়কে অবহেলা করেন না সত্তরোর্ধ্ব এই নারী। তাই বেলা থাকতেই উঠেছেন বাড়ির পাশের রিজিভিয়া সিদ্দিকিয়া ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে।
গতকাল শনিবার বাঁশখালীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ উপকূলীয় ইউনিয়ন খানখানাবাদের কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, বয়স্ক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী লোকজন বেলা থাকতেই সেখানে উঠেছেন। তাঁদের কেউ আসছেন সন্তানদের কোলে চড়ে, কেউ আসছেন স্ট্রেচারে ভর দিয়ে। অনেকে অটোরিকশায় করে উপকূলীয় এলাকা ত্যাগ করছেন। গবাদিপশুকেও নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যেতে দেখা গেল। কেউ কেউ পিচ্ছিল রাস্তায় স্যান্ডেল হাতে নিয়ে ব্যাগ-বোঁচকা মাথায় নিয়ে রওনা আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে।
সরকারের ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) সদস্যদের উপকূলীয় এলাকায় মাইকিং করতে দেখা গেছে। মহাবিপদ সংকেতের চিহ্ন হিসেবে বেড়িবাঁধে তিনটি লাল পতাকা তুলেছেন তাঁরা।
ফাতেমা বেগম এখন একমাত্র ছেলেকে নিয়ে বসবাস করছেন। ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে চার সন্তানকে হারানোর কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ে দুই ছেলে, দুই মেয়েকে হারিয়েছি। সবাই ছিল শিশু। সাত মাসের কোলের সন্তানও ছিল। সেই রাত বাড়িতেই ছিলাম। ধারণা করেছিলাম কোনো ক্ষয়ক্ষতি হবে না। আর তখন এত সতর্কতার বার্তাও দেওয়া হতো না। রাতে ঘরে সমুদ্রের লোনা পানি ঢুকে সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এরপর থেকে ঘূর্ণিঝড়ের বিপৎসংকেত দিলেই আশ্রয়কেন্দ্রে দ্রুত চলে আসি।’
ছেলের কোলে চড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে আসা ৮৫ বছর বয়সের আবদুর রহমান বলেন, ‘বয়সের ভারে চলতে পারি না। তাই ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত থেকে রক্ষা পেতে আগেভাগেই রিজিভিয়া সিদ্দিকিয়া ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছি।’ তাঁর বাড়ি খানখানাবাদের প্রেমাশিয়া এলাকায়।
অটোরিকশায় করে এলাকা ত্যাগ করার সময় গতকাল দুপুরে কথা হয় একই এলাকার জামাল উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে কালীপুরের গুনাগরিতে এক আত্মীয়ের বাড়িতে যাচ্ছি।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোমেনা আক্তার বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের খবর জানাতে একটি নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলা হয়েছে। এ ছাড়া সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। সিপিপির সদস্যরা উপকূলীয় লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার জন্য মাইকিং করছে। তিনি আরও জানান, বাঁশখালীতে ব্যবহার উপযোগী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ১০২। এ ছাড়া উপকূলীয় এলাকার বিদ্যালয়গুলোকেও আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
খানখানাবাদ ইউনিয়নের উত্তর প্রেমাশিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং রিজিভিয়া সিদ্দিকিয়া ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র পরিদর্শন করে দেখা গেছে, সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় ৩০ জনের মতো বয়স্ক ও শিশু সেখানে আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্র দুটি দ্বিতলবিশিষ্ট। এর মধ্যে রিজিভিয়া সিদ্দিকিয়া ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রটিতে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ২০ জনের মতো।
জানা যায়, উপকূলীয় ইউনিয়ন ছনুয়ার দুটি আশ্রয়কেন্দ্রে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ৫৫ জনের মতো নারী, পুরুষ ও শিশু আশ্রয় নিয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, রাতের দিকে আরও লোকজন আশ্রয়কেন্দ্রে যাবেন।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) আবুল কালাম মিয়াজি গতকাল রাত সোয়া ১০টায় প্রথম আলোকে বলেন, উপকূলীয় ছয়টি ইউনিয়নের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।