শীত, তবু গাছে গাছে আম

>

• কনকনে শীতে গাছে ঝুলছে আম
• বই পড়ে পড়ে আমবাগানের পরিচর্যার বিষয়ে জেনেছেন সিরাজুল ইসলাম
• ফলন দেখে তিনি নিজেও অবাক হয়ে যান

কনকনে শীত। মৃদুমন্দ বাতাস। তাতে আয়েশি দোল খাচ্ছে থোকা থোকা আম। এই মনোহর দৃশ্য চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের নওদাপাড়ার সিরাজুল ইসলামের বাগানে। একটি দুটি নয়, বাগানের প্রায় শ দুয়েক গাছে আম ঝুলে আছে। বাগানটির বয়স মাত্র চার বছর।

‘এই সময় গাছে গাছে আম। ভাবাই যায় না। দারুণ এক ব্যাপার। আমরা যা করতে পারিনি, তা করে দেখিয়েছেন গ্রামের এক আমচাষি।’ উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে পারেননি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের চাঁপাইনবাবগঞ্জের উপপরিচালক মঞ্জুরুল হোদা।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের (আম গবেষণা কেন্দ্র) মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শফিকুল ইসলামসহ গোমস্তাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও শিবগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে আমবাগানটি দেখতে গেছেন মঞ্জুরুল হোদা।

সিরাজুল ইসলামের আমবাগানে ঢুকতেই ছোট ছোট গাছের আমভর্তি ডাল আপনাকে যেন কুর্নিশ করবে। আসলে আমের ভারে নুয়ে পড়েছে সব ডাল। অশক্ত ডালে ধরা অনেক আম গিয়ে ঠেকেছে মাটিতে।

বাগানে দর্শনার্থীর ভিড়ও আছে। অসময়ে এমন আম ফলিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন সিরাজুল। ফলে সাড়া পড়েছে আশপাশের এলাকায়। প্রতিদিনই লোকজন আসছেন বাগানে। সেখানেই কথা হয় পাশের গ্রামের দানেশ আলী, আমিনুল ইসলাম, নার্সারির মালিক রবিউল ইসলামসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে। তাঁরা জানান, বাগানে আমের ছড়াছড়ি দেখে তাঁরা সত্যিই অবাক হয়েছেন। বাগান থেকে কুশি সংগ্রহ করে বা এই জাতের চারা সংগ্রহ করে এমন গাছ তাঁরাও লাগাতে চান।

সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মৌসুমে চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমের দরপতন দেখে তিনি ভাবতে থাকেন অসময়ের আম চাষ করার কথা। ঢাকা থেকে তিনি তাঁর বড় ভাইয়ের মাধ্যমে কুশি (সায়ন) অর্থাৎ কলম বাঁধার উপযোগী কচি ডগা সংগ্রহ করেন। ২০১৭ সালে তিন বছর বয়সী গাছে সে কলম বাঁধেন। ওই বছর ফাল্গুন মাসে গাছে মুকুল আসে। এরপর আরও তিনবার মুকুল দেয়। কিন্তু ফলন ভালো হয়নি বলে মুকুল ভেঙে ফেলেন। এবারও মৌসুমের সময়ে অর্থাৎ ফাল্গুন মাসে ও তারপরের সব মুকুল ভেঙে ফেলেন তিনি। কিন্তু আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে প্রচুর মুকুল আর ফলন দেয় গাছ। ফলন দেখে তিনি নিজেও অবাক হয়ে যান।

সিরাজুল ইসলাম জানান, বই পড়ে পড়ে তিনি আমবাগানের পরিচর্যার বিষয়ে জেনেছেন। সে অনুযায়ী ডাল ছাঁটাই করেছেন। আর তাতে ফলও পেয়েছেন তিনি।

ইতিমধ্যে ১৮ থেকে ২০ মণ আম বিক্রি করেছেন সিরাজুল। সবই গেছে চট্টগ্রাম ও কুমিল্লার বাজারে। শুরুতে প্রতি কেজি আম বিক্রি করেছেন ২৭৫ টাকায়। ক্রমান্বয়ে তা বাড়তে বাড়তে এখন এসে দাঁড়িয়েছে ৩৪০ টাকায়।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের নওদাপাড়ার সিরাজুল ইসলামের বাগানে থোকা থোকা আম। ছবি: প্রথম আলো

বাগানে আর কী পরিমাণ আম আছে জানতে চাইলে সিরাজুল ইসলাম জানান, যে পরিমাণ আম ইতিমধ্যে বিক্রি করেছেন, বাগানে এখনো সেই পরিমাণ আম আছে। আমগুলো একে একে পুষ্ট হচ্ছে। তিনি আশা করছেন, শেষ দিকে আরও বেশি দাম পাবেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মঞ্জুরুল হোদা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বইপুস্তকেই আছে ডাল ছাঁটাইয়ের সুফলের কথা। আমরা কৃষিবিদ বা গবেষকেরা চাষিদের কাছে এই জ্ঞানটি যথাযথভাবে বিতরণ করতে পারিনি। কিন্তু আমচাষি সিরাজুল ইসলাম সেটা নিজেই করে দেখিয়েছেন।’ তিনি জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমের দরপতনের কারণে গত দু-তিন মৌসুমে আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কিন্তু অসময়ে আম ফলিয়ে সিরাজুল ইসলাম দারুণ লাভবান হয়েছেন। তাঁর এক বিঘার বাগানে এবার ৪ লাখ টাকা আয় হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আমচাষিদের জন্য এটা একটা দারুণ সুখবর।

সিরাজুল ইসলাম জানান, অনেকেই তাঁর কাছ থেকে এই আমের চারা সংগ্রহ করতে চান। তিনিও চান এ আম ছড়িয়ে পড়ুক। অসময়ে আম ফলিয়ে চাষিরা লাভবান হোক।

আম গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, এই আমের জাতটি বারি আম-১১। এ জাতের গাছে বছরে তিনবার মুকুল আসে। এ আমের স্বাদও ভালো। সিরাজুল ইসলাম মৌসুমের মুকুলে ফলন না নিয়ে আগস্ট-সেপ্টেম্বরের মুকুলে ফলন নিয়েছেন। পরীক্ষামূলকভাবে এ কাজ করে তিনি ভালো ফল পেয়েছেন। দামও ভালো পাওয়া যাচ্ছে। ফলে অসময়ের আমের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়বে।