ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও গাজীপুর জেলাজুড়ে বিস্তৃত শালবন। তবে বছর বছর উজাড় হচ্ছে এই অমূল্য সম্পদ। বনের গাছ কেটে সাবাড় করে উঠছে বাড়িঘর। যেখানে আগে বন ছিল, এখন সেখানে চলছে চাষাবাদ। বনভূমি কমে যাওয়ায় ধীরে ধীরে বন্য প্রাণীও বিলুপ্ত হচ্ছে। এই অবস্থার অবসানে বড় এক উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
সরকারি এই প্রকল্পের নাম টেকসই বন ও জীবিকা (সুফল)। ইংরেজি নাম ‘সাটেইনেবল ফরেস্ট অ্যান্ড লাইভলিহুড’ থেকে এসেছে ‘সুফল’ শব্দটি। প্রকল্পের আওতায় রয়েছে সারা দেশের পাঁচটি বনাঞ্চল, যার একটি ময়মনসিংহ অঞ্চলের শালবন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দিনে দিনে শালবনের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে। তবে সুফল প্রকল্পটি কিছুটা হলেও শালবনের সুদিন ফেরাবে বলে তাঁরা আশাবাদী। কারণ, প্রকল্পের আওতায় এখানে বড় পরিসরে বিভিন্ন ধরনের গাছ লাগানো হবে। এতে বনভূমি যেমন বাড়বে, তেমনি বন্য প্রাণীর সংখ্যাও বাড়বে। বন্য প্রাণীদের আবাসস্থল ও খাদ্যের ঘাটতি পূরণের কথা মাথায় রেখেই গাছের প্রজাতি নির্বাচন করা হয়েছে।
প্রকল্প বাস্তবায়নে গাছের চারার জোগান পেতে ইতিমধ্যে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার সন্তোষপুর এবং রাঙামাটিয়া গ্রামে দুটি নার্সারি গড়ে তোলা হয়েছে। স্থানীয় সন্তোষপুর বিট কর্মকর্তা আশরাফ আলী প্রথম আলোকে বলেন, সুফল প্রকল্পের আওতায় বিলুপ্ত বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা রোপণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। নার্সারি দুটিতে শাল, গর্জন, সোনালু, লটকন, নাগেশ্বর, বন আমড়া, খাড়াজোড়া, গামার, নেওড়, কুম্ভি, কানাইডাঙ্গা, জলপাই, কদম, জামসহ বিভিন্ন গাছের চারা প্রস্তুত করা হচ্ছে। এসব গাছ রোপণের পর বড় হয়ে উঠলে তা বনের পরিসর ব
ৃদ্ধির পাশাপাশি বিভিন্ন প্রজাতির বন্য প্রাণীর আবাস্থল ও খাদ্যসংকট দূর করবে বলে তাঁরা আশা করছেন।
বন বিভাগের লোকজন ও স্থানীয় বাসিন্দা সূত্রে জানা গেছে, ময়মনসিংহ অঞ্চলের এই শালবন ভাওয়াল ও মধুপুরের গড় নামে পরিচিত। ময়মনসিংহের ভালুকা, মুক্তাগাছা ও ফুলবাড়িয়া; টাঙ্গাইলের মধুপুর, ধনবাড়ি এবং গাজীপুরের শ্রীপুর ও কাপাসিয়া এলাকাজুড়ে এর বিস্তৃতি। তবে দিনে দিনে বনের বিভিন্ন এলাকা দখল হয়ে গেছে। বন রক্ষায় সঠিক নজরদারি না থাকায় অনেক এলাকার গাছ কেটে সাবাড় করে ফেলা হয়েছে। এসব এলাকায় বাড়িঘর তুলে বাস করছে অনেক পরিবার। অনেক স্থানে গাছ কেটে সাফ করে চাষাবাদ শুরু করেছে স্থানীয় বাসিন্দারা।
সন্তোষপুর গ্রামের বাসিন্দা আইয়ুব আলী বলেন, একটা সময়ে শালবনে বাঘ, হরিণ, অজগর, শকুন, হনুমান, কাঠবিড়ালিসহ বিভিন্ন প্রাণীর উপস্থিতি ছিল। কিন্তু এখন বনের আয়তন ও গাছের পরিমাণ কমে যাওয়ায় কিছু বানর আর কয়েক প্রজাতির পাখি ছাড়া আর তেমন কোনো বন্য প্রাণীর দেখা মেলে না। জয়নাল মিয়া নামে আরেকজন বলেন, ছোটবেলায় তিনি অনেক বন্য প্রাণী দেখেছেন, কিন্তু বনভূমির পরিমাণ কমে যাওয়ায় এবং বন্য প্রাণীর খাবারের ঘাটতি হওয়ায় সেগুলো আজ প্রায় বিলুপ্ত। খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে গিয়ে ধরা পড়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের আক্রমণে মৃত্যুর ঘটনাও আছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বদিউজ্জামান খান জীববৈচিত্র্য–সংক্রান্ত নিয়ে গবেষণা করেছেন ২০১৩ সালে। এতে দেখা গেছে, বর্তমানে এই বনে ২১ প্রজাতির গাছ এবং ১৭ প্রজাতির প্রাণী রয়েছে। বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ১৯৯০ সালে এই শালবনের আয়তন ছিল ২৩ হাজার ৬৫০ হেক্টর। ২০১৫ সালে এই বনভূমি ১৭ হাজার ৪৯ হেক্টরে হ্রাস পেয়েছে।
দেশের বন উজাড় রোধসহ কয়েকটি উদ্দেশ্য মাথায় রেখেই পাঁচ বছর মেয়াদি ‘সুফল’ প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে সরকারি বনজ সম্পদ ব্যবস্থাপনা, বন সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ বাড়ানো এবং বননির্ভর জনগোষ্ঠীর বিকল্প জীবিকা সুবিধা দেওয়া। ২০১৮ সালে প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৫০২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। ব্যয়ের সিংহভাগই দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। এই টাকায় যে পাঁচটি বনাঞ্চল রক্ষায় কাজ করার কথা, সেগুলো ২৮টি জেলায় বিস্তৃত। এসব জেলার ৬০০ গ্রামে নতুন করে ৭৭ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে ‘সুফল’ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর আওতায় বনায়ন ও বন্য প্রাণী আবাসস্থল গড়ে তোলা, বিপন্ন বন্য প্রাণী সংরক্ষণ, বিপন্ন প্রজাতির গাছপালার তালিকা তৈরি, বননির্ভর পরিবারগুলোর আর্থসামাজিক উন্নয়ন করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
প্রকল্পের আওতায় ময়মনসিংহ অঞ্চলের শালবনে আগামী জুন মাস থেকে বিভিন্ন জাতের ৩ লাখ ৯৫ হাজার গাছের চারা রোপণ করা হবে। সেই চারার জোগান পেতেই ফুলবাড়িয়ার সন্তোষপুর এবং রাঙামাটিয়া গ্রামে নার্সারি দুটি গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে এখন দিন–রাত চারা গাছগুলোর যত্ন নেওয়া হচ্ছে।
শালবনের সেই হারানো সুদিন ফিরিয়ে আনতে সুফল প্রকল্পের আওতায় নেওয়া এই উদ্যোগ বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন ময়মনসিংহ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ কে এম রুহুল আমীন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, চারা গাছগুলো রোপণের পর দ্রুত বেড়ে উঠলে কয়েক বছরের মধ্যেই একটা পরিবর্তন দৃশ্যমান হবে। তখন এই অঞ্চলে শালবন তার অতীত ঐতিহ্য ফিরে পাবে। গাছগাছালি বাড়লে বন্য প্রাণীর সংখ্যাও বাড়বে। এটা প্রাকৃতিক ভারসাম্য সুরক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।