বায়ুদূষণের পর এবার শব্দদূষণেও বিশ্বের শীর্ষ স্থানটি দখল করল ঢাকা। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি ইউএনইপির প্রকাশ করা এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
শব্দদূষণে ঢাকার পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে ভারতের উত্তর প্রদেশের মুরাদাবাদ ও পাকিস্তানের ইসলামাবাদ। শব্দদূষণে বাংলাদেশেরই আরেক শহর রাজশাহী রয়েছে চতুর্থ স্থানে। আর পঞ্চম অবস্থানে ভিয়েতনমের হো চি মিন শহর।
এর আগে একাধিকবার বায়ুদূষণে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শহরের তালিকায় ১ নম্বরে নাম ওঠে রাজধানী ঢাকার। সর্বশেষ গত সপ্তাহে বায়ুদূষণের দিক থেকে ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় উঠে আসে।
শব্দদূষণ নিয়ে ‘ফ্রন্টিয়ার্স ২০২২: নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে শব্দদূষণ কীভাবে মানুষের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা প্রভাবিত করছে, সে বিষয়েও তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, শব্দদূষণে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় পাঁচ শহরের তিনটির অবস্থানই দক্ষিণ এশিয়ায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গাইডলাইন বা নির্দেশনা অনুযায়ী মানুষের জন্য ঘরের ভেতর শব্দের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫৫ ডেসিবেল। আর ঘরের বাইরে বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবেল। অথচ ঢাকায় এই মাত্রা ১১৯ ডেসিবেল ও রাজশাহীতে ১০৩ ডেসিবেল।
শব্দদূষণের প্রধান উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে সড়কে যানজটকালে যানবাহন থেকে নির্গত শব্দ, উড়োজাহাজ, ট্রেন, শিল্পকারখানা ও বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডে সৃষ্ট শব্দ। এসব শব্দ মানমাত্রার চেয়ে বেশি হলে তা মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে বিপদে ফেলে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
গবেষণায় বিশ্বের কয়েকটি বড় শহরের শব্দদূষণের কারণে সৃষ্ট সমস্যাগুলো তুলে ধরা হয়। বলা হয়, কানাডার টরন্টো শহরে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৮ শতাংশ ও উচ্চ রক্তচাপের রোগীর সংখ্যা ২ শতাংশ বেড়েছে।
করোনাকালে বিশ্বের অনেক শহরে শব্দদূষণের পরিমাণ কমে যাওয়ার উদাহরণও দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, ওই সময়কালে যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকো থেকে শুরু করে ভারতের মুম্বাই শহরে শব্দের মাত্রা ৩ থেকে ৭ ডেসিবেল পর্যন্ত কমে আসে। এসব শহরে পাখির ডাক শোনা যাওয়াসহ নানা ইতিবাচক ঘটনাও ঘটেছে। তবে বাংলাদেশের শহরগুলোতে এমন ঘটনা ঘটেনি।
প্রসঙ্গত, শব্দদূষণ দিন দিন বাড়ছে। তবে তা শুধু রাজধানী ঢাকাতে নয়; সারা দেশেই। যানজট বাধলেই চারপাশ থেকে হর্ন বাজানো শুরু হয় সব ধরনের যানবাহনের। মনে হয়, শুধু হর্ন বাজালেই যানজট কেটে যাবে। মাঝে জটে আটকে থাকা মানুষের কান ঝালাপালা হওয়ার দশা। শব্দদূষণের উৎস শুধু যানবাহন নয়। বাড়িঘর ও অন্যান্য স্থাপনার নির্মাণকাজের শব্দ, উচ্চস্বরে মাইক বাজানো, কোনো উৎসব অনুষ্ঠানে উচ্চ শব্দে গান বাজানো—এগুলোও শব্দদূষণে ভূমিকা রাখছে।
দেশের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত সচিবালয়ও শব্দদূষণের শিকার। প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবর থেকে জানা গেছে, সম্প্রতি সচিবালয়–সংলগ্ন জিরো পয়েন্ট মোড়ে একটি সাউন্ড প্রেশার লেভেল (এসপিএল) মিটারে ওই স্থানের শব্দের মাত্রা পাওয়া যায় ১২৮ দশমিক ৬ ডেসিবেল। অথচ শব্দদূষণ বিধি অনুযায়ী, নীরব এলাকা হিসেবে চিহ্নিত সচিবালয়ের ওই স্থানে শব্দের মাত্রা থাকার কথা ৫০ ডেসিবেল।
স্বীকৃত বৈজ্ঞানিক নিয়ম অনুযায়ী, শব্দের মাত্রা ৮৫ ডেসিবেল বা তার বেশি হলে তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। অস্ট্রেলিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক নিবন্ধ থেকে জানা গেছে, উচ্চ শব্দের মধ্যে থাকতে থাকতে একজন মানুষের শ্রবণশক্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। উচ্চ শব্দ মানুষের ঘুমেও ব্যাঘাত সৃষ্টি করে।
শব্দদূষণে অন্যান্য শারীরিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে। উচ্চ শব্দে মানুষের উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্রোগ ও উদ্বেগজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে। এসব সমস্যা দেখা দিতে পারে সব বয়সের মানুষেরই। তবে বিশেষভাবে ক্ষতি হতে পারে শিশুদের। দিনের পর দিন শব্দদূষণের শিকার শিশুদের মনোযোগ দেওয়ার ও কিছু পড়ার ক্ষমতা লোপ পেতে পারে।
এ দেশে ২০০৬ সাল থেকে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা আছে। এই বিধিমালা অনুযায়ী শব্দদূষণের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান আছে। কিন্তু তা আসলে কতটুকু কার্যকর, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হলে আজ হয়তো শব্দদূষণ এত মারাত্মক হয়ে উঠত না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।