ছয় বছরের সন্তান টিউলিপকে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছেন গাজীপুরের জয়দেবপুর কেন্দ্রীয় মসজিদ রোডের মো. শহিদুল। জয়দেবপুর লেভেল ক্রসিংয়ের কাছে যেতেই সিগন্যালে আটকা পড়েন। প্রায় পাঁচ মিনিট পর সিগন্যাল উঠল। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় দুই পাশে আটকা পড়া যানবাহনের ভেঁপু (হর্ন) বাজানো। ভেঁপুর গগনবিদারী শব্দে কান ঝালাপালা হওয়ার উপক্রম। অসহ্য শব্দ থেকে বাঁচতে কান চেপে ধরে আছে ছোট্ট টিউলিপ।
এই চিত্র সাম্প্রতিক। শহিদুল বলেন, ‘ও (টিউলিপ) ছোট মানুষ। তাই এত শব্দ সহ্য করতে পারে না। মাঝেমধ্যে কান্নাকাটি শুরু করে। স্কুলে যাওয়ার সময় প্রতিদিনই এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়।’
গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত শব্দের মানমাত্রা অনুযায়ী নগরে শব্দের মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে নেই। পথচারী, সড়কের পাশের দোকানি ও সাধারণ মানুষ নিয়মিত শব্দদূষণের শিকার হচ্ছে। শুধু এই সড়কই নয়, গাজীপুর নগরের বিভিন্ন এলাকায় শব্দদূষণের প্রায় একই রকম চিত্র পাওয়া গেছে।
অতিমাত্রায় শব্দ মানবদেহের কী ক্ষতি করে—জানতে চাওয়া হয়েছিল দুজন চিকিৎসকের কাছে। এর মধ্যে টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ রোকসানা পারভিন বলেন, শব্দদূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় শিশুদের। মাত্রাতিরিক্ত শব্দের কারণে শিশুদের মনঃসংযোগে অভাব, খিটখিটে ভাব, দেখা দেয় অস্থিরতা ও ক্ষুধামান্দ। তা ছাড়া শব্দের তীব্রতা ৮৫ ডেসিবেলের বেশি হলে শ্রবণশক্তি হ্রাস পাবে। তা কোনোভাবে ১২০ ডেসিবেল হলে শ্রবণশক্তি স্থায়ীভাবে লোপ পাবে। আর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক (নাক, কান, গলা) মো. মোস্তফা কামাল হোসেন বলেন, রোগের (কনডাকটিভ ডেফনেস) কারণে কানে সমস্যা হলে তা চিকিৎসায় ভালো হয়। কিন্তু কানে শব্দজনিত সমস্যা হলে তা চিকিৎসায় ভালো হতে চায় না। তা ছাড়া অতিমাত্রার শব্দে মাথাব্যথা, মাথা ঘোরানো, বমি বমি ভাবসহ মাইগ্রেন দেখা দেয়। ৪০ বছরের নিচে বেশির ভাগ রোগীই শব্দদূষণজনিত সমস্যা নিয়ে আসে।
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০০৬ অনুযায়ী ‘নীরব’ এলাকায় শব্দের সহনীয় মাত্রা রাতে ৪০ ডেসিবেল, দিনে ৫০ ডেসিবেল। আবাসিক এলাকায় শব্দের সহনশীল মাত্রা রাতে ৪৫ ডেসিবেল, দিনে ৫৫ ডেসিবেল। মিশ্র এলাকায় (বাণিজ্যিক ও আবাসিক) রাতে সহনীয় মাত্রা ৫০ ডেসিবেল, দিনে ৬০ ডেসিবেল। বাণিজ্যিক এলাকায় রাতে ৬০ ও দিনে ৭০ ডেসিবেল। শিল্প এলাকায় রাতে ৭০ ডেসিবেল, দিনে ৭৫ ডেসিবেল। বিধি অনুযায়ী হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত বা এ–জাতীয় প্রতিষ্ঠান নীরব এলাকার অন্তর্ভুক্ত।
গত ৯ মার্চ নগরের বিভিন্ন এলাকায় শব্দের মানমাত্রা পরীক্ষা করে গাজীপুর জেলা পরিবেশ অধিদপ্তর। দেখা যায়, চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় শব্দের সর্বনিম্ন মাত্রা ৫১ ডেসিবেল, সর্বোচ্চ ৮৭ ডেসিবেল (দুপুর)। ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজের গেটের সামনে সর্বনিম্ন মাত্রা ৬৭ ডেসিবেল, সর্বোচ্চ ৮৭ ডেসিবেল (বিকেল)। জয়দেবপুর লেভেল ক্রসিং এলাকায় সর্বনিম্ন মাত্রা ৭৭ ডেসিবেল, সর্বোচ্চ ৮৭ ডেসিবেল (বিকেল)। জয়দেবপুর রানী বিলাসমণি স্কুলের সামনে শব্দের সর্বনিম্ন মাত্রা ৫৬ ডেসিবেল, সর্বোচ্চ ৮৪ ডেসিবেল (বিকেল)।
শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজের সামনে শব্দের সর্বনিম্ন মাত্রা রেকর্ড করা হয় ৫২ ডেসিবেল, সর্বোচ্চ ৮৫ ডেসিবেল (সন্ধ্যা)। টঙ্গী স্টেশন রোড এলাকায় শব্দের সর্বনিম্ন মাত্রা ৬৩ ডেসিবেল, সর্বোচ্চ ৮৪ ডেসিবেল (বিকেল)। টঙ্গী কলেজ গেট এলাকায় সর্বনিম্ন মাত্রা ৭৪, সর্বোচ্চ ৭৭ ডেসিবেল (বিকেল)। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গেটে শব্দের সর্বনিম্ন মাত্রা ৫৯ ডেসিবেল, সর্বোচ্চ ৭৮ ডেসিবেল (বিকেল)। ভোগড়া বাইপাস এলাকায় সর্বনিম্ন ৬৮ ও সর্বোচ্চ ৮৫ ডেসিবেল শব্দের মাত্রা রেকর্ড হয় (বিকেল)। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট গেটে সর্বনিম্ন মাত্রা ৫৬ ডেসিবেল, সর্বোচ্চ ৭৮ ডেসিবেল।
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালায় বলা হয়েছে, নীরব এলাকার চারদিকে ১০০ মিটার পর্যন্ত কোনো ধরনের ভেঁপু বাজানো যাবে না। আবাসিক এলাকার ৫০০ মিটারের মধ্যে নির্মাণকাজের জন্য ইট ভাঙার যন্ত্র ব্যবহার করা যাবে না। কোনো উৎসব, সামাজিক বা রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে লাউড স্পিকার, অ্যামপ্লিফায়ার বা শব্দের মাত্রা বর্ধনকারী অন্য কোনো যন্ত্র ব্যবহার করতে হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে। তা ছাড়া এসব কার্যক্রম চলবে টানা সর্বোচ্চ ৫ ঘণ্টা এবং রাত ১০টার পর কোনোভাবেই এসব যন্ত্র ব্যবহার করা যাবে না।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) গাজীপুর জেলা সাধারণ সম্পাদক হাসান ইউসুফ খান বলেন, ‘শব্দদূষণসংক্রান্ত সরকারি যে বিধিমালা আছে তা প্রয়োগের দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের। এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পরিবেশ অধিদপ্তর মানুষের কাছে যেতে পারে, সচেতনতামূলক প্রচারপত্র বিতরণ করতে পারে, কিন্তু তারা এসব কিছুই করছে না।’
জানতে চাইলে গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রধান মো. আ. সালাম বলেন, ইতিমধ্যে হাইড্রোলিক হর্ন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়। আর পরিবেশ অধিদপ্তর চাইলেও সব সময় মোবাইল কোর্ট করতে পারে না। এ জন্য জেলা প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা দরকার হয়।
গাজীপুর জেলা প্রশাসক দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর বলেন, ‘আমরা শুধু মোটরযানের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট করতে পারি। কিন্তু শব্দদূষণের অন্যান্য যে কারণ আছে তা দেখার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। সে ক্ষেত্রে তারা চাইলে আমরা সহযোগিতা দিই।’
শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ অনুযায়ী আবাসিক, বাণিজ্যিক, মিশ্র, শিল্প ও নীরব এলাকাগুলো চিহ্নিত করে সাইনবোর্ড বা সংকেত ব্যবহারের নির্দেশনা রয়েছে। আর তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের ওপর। কিন্তু গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কোথাও এ ধরনের সাইনবোর্ড বা সংকেত দেখা যায়নি।
জানতে চাইলে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সাইনবোর্ড বা সংকেত না থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘আমার জানামতে, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কোথাও পরিবেশদূষণ করার মতো শব্দ হচ্ছে না। তাই এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।’