ঈশ্বরদী এখন পাকা লিচুর রঙে রঙিন। পুরো উপজেলাই যেন লিচুবাগান। প্রতিটি বাড়ির উঠানে, সামনে-পেছনে দু-একটি লিচুগাছ আছেই। আর উপজেলার দক্ষিণ অংশে মাইলের পর মাইল টানা লিচুবাগান। গাছে গাছে ঝুলছে রঙিন লিচুর থোকা। এবার ফলনও হয়েছে খুব ভালো। লিচু সংগ্রহ করে ঝুড়িতে সাজানো, ট্রাকে তোলা নিয়ে যেন উৎসব শুরু হয়েছে।
পাবনা অঞ্চলে ঈশ্বরদীর খ্যাতি এখন ‘লিচুর রাজধানী’ হিসেবে। তার কারণও আছে। উপজেলা কৃষি বিভাগের জরিপ অনুসারে, এখানে তিন হাজার হেক্টর জমিতে লিচুর বাণিজ্যিক বাগান রয়েছে। গাছের সংখ্যা তিন লাখের ওপর। এর মধ্যে দুই লাখ গাছের বয়স ১৫ বছরের বেশি। এ ছাড়া সারা উপজেলাতেই বসতবাড়ির আশপাশেও রয়েছে প্রচুর লিচুগাছ। লিচু চাষ লাভজনক হওয়ায় প্রতিবছরই বাগানের সংখ্যা বাড়ছে বলে জানান উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রওশন জামাল। তাঁদের হিসাবে বড় গাছগুলোতে এবার নিম্নে ১০ হাজার, ঊর্ধ্বে ২৫ হাজার পর্যন্ত লিচু ধরেছে। অপেক্ষাকৃত ছোট গাছে লিচু এসেছে তিন থেকে পাঁচ হাজার পর্যন্ত। বড় গাছে গড়ে ১০ হাজার ও ছোট গাছে ৩ হাজার করে ধরলে এবার লিচুর সংখ্যা প্রায় ২৩০ কোটি। পাইকারিতে গড়ে প্রতি লিচুর দাম দেড় টাকা ধরা হলেও দাম হয় ৩৪৫ কোটি টাকা। এর সঙ্গে যোগ হবে বসতবাড়ির আশপাশের গাছের লিচুর দাম। বাগানে গতকাল সোমবার পাইকারিতে প্রতি হাজার লিচু বিক্রি হয় ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ২০০ টাকায়। লিচুচাষি আর স্থানীয় কৃষি বিভাগের অনুমান, এবার প্রায় ৪০০ কোটি টাকার লিচু বিক্রি হবে ঈশ্বরদীতে।
সরেজমিনে গত সপ্তাহে দেখা গেল ঈশ্বরদীর লিচুবাগানগুলোতে বিপুল কর্মচাঞ্চল্য। সবচেয়ে বেশি লিচুবাগান পৌর এলাকা, সলিমপুর, সাহাপুর, লক্ষ্মীকুণ্ডা, দাশুড়িয়া, সাড়া, মুলাডুলি, জয়নগর, মানিকনগর, মিরকামারি, আওতাপাড়া, বড়ইচড়া, বাঁশের কাটা, চাঁদপুর চর, কামালপুর চর এলাকায়। এখানে আঁটির গাছের দেশি লিচু এবং কলম করে বোম্বাই লিচুর চাষ হয়। লিচুগাছগুলোর মাথায় বাঁশে করে তোলা হয়েছে সাদা কাপড়ের নিশান। এর কোনো কোনোটির সঙ্গে আছে বৈদ্যুতিক বাল্ব। মানিকনগরের লিচুচাষি বাদশাহ প্রামাণিক বললেন, এটা হলো বাদুড় তাড়ানোর ব্যবস্থা। আগে তাঁরা গাছের মগডালে কেরোসিন টিনের ঘণ্টা বেঁধে তার সঙ্গে থাকা লম্বা দড়ি টেনে আওয়াজ করে বাদুড় তাড়াতেন।
বাড়ির বাইরে কেউ কেউ বাঁশের মাচান তৈরি করে তার ওপর চাটাইয়ের ছাউনি দিয়ে টং তৈরি করেছেন। সেখানে রাতভর আড্ডা জমে। বড় বড় সাউন্ড বক্স বসিয়ে বাজানো হয় জনপ্রিয় বাংলা-হিন্দি গান। বাগানগুলোও সব গায়ে গায়ে লাগানো। সারা রাত থাকে লোক চলাচল। ইদানীং লিচুর বাগান ভাঙার আগে আগে মেয়ে-জামাই বা দূরের আত্মীয়-বন্ধুবান্ধবকেও দাওয়াত দিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসেন অনেকে। বাগানেই চুলা করে রান্নাবান্না। ফলে বাদুড়কুল আর সাহস পায় না লিচুবাগানে হানা দেওয়ার।
বাদশা প্রামাণিকের বাড়ি লিচুবাগানের ভেতরেই। তাঁর দেড় বিঘা করে দুটি বাগান। লিচু বিক্রি করেই কাঁচা বাড়ি পাকা করেছেন। প্রতি বিঘায় ১৬ থেকে ১৮টি গাছ। ফলন ভালো হলে আড়াই থেকে তিন লাখ, কম হলে নিম্নে এক লাখ টাকা থাকে। যেকোনো সবজির চেয়ে লিচুতে বিঘাপ্রতি আয় বেশি। উপরন্তু লিচুর বাগানে আদা, হলুদ এসবের চাষ করা যায়। মাটিও লিচুর উপযোগী। আগে থেকেই কিছু কিছু লিচুগাছ এখানে ছিল। কিন্তু বাণিজ্যিক বাগান করা শুরু হয় গত শতকের আশির দশক থেকে। লাভ বেশি বলে দ্রুত ঈশ্বরদীতে লিচু চাষের ব্যাপক বিস্তার ঘটে।
সাহাপুরের হাসেম উদ্দিনের তিন বিঘায় লিচুবাগান। তিনি বললেন, এখানে দুভাবে লিচুর ব্যবসা হয়। ফাল্গুন মাসে লিচুর ফুল আসে। ফুল থেকে গুটি বের হলেই ব্যাপারীরা গুটি অনুমান করে দাম ধরে আগাম বাগান কিনতে শুরু করেন। এরপর বাগানের পরিচর্যা, সেচ, সার, কীটনাশক থেকে যাবতীয় খরচ ব্যাপারীদের। আবার অনেক চাষি নিজেরাই পরিচর্যা করে বাগান ভেঙে পাইকারদের কাছে লিচু বিক্রি করেন।
লিচুর ব্যবসা মাত্র তিন সপ্তাহের। জ্যৈষ্ঠের প্রথম থেকে ২০-২২ তারিখ পর্যন্ত। এখন ভরা মৌসুম। প্রতিদিন বিশাল লিচুর হাট বসছে জয়নগর, শিমুলতলা, আওতাপাড়া মোড়, সিলিমপুর মোড়ে। হাজার হাজার ঝুড়িতে ভরা হচ্ছে লাল টুকটুকে লিচু। তোলা হচ্ছে ট্রাকে। ঈশ্বরদীর লিচু যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়।