জাতিসংঘের বিশেষ দূতের আহ্বান

রামপালসহ সুন্দরবনের চারপাশের শিল্প বন্ধ করুন

সুন্দরবন। প্রথম আলো ফাইল ছবি
সুন্দরবন। প্রথম আলো ফাইল ছবি

সুন্দরবনের সংরক্ষিত এলাকার পাশে শিল্প-কারখানা স্থাপন অবশ্যই বন্ধ করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার ও পরিবেশবিষয়ক বিশেষ দূত জন এইচ নক্স।

গত মঙ্গলবার দেওয়া ওই বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে চিহ্নিত ওই বনটি জাতিসংঘ ঘোষিত রামসার এলাকা বা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্যপূর্ণ জলাভূমি। এখানে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠলে তা শুধু বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই ম্যানগ্রোভ বনের জন্যই হুমকি না। এই বনে বসবাসকারী বেঙ্গল টাইগার, ডলফিন ও অন্যান্য বিপদাপন্ন বন্য প্রাণীর অস্তিত্বের জন্যও হুমকি।

জন এইচ নক্স বলেন, শুধু বন্য প্রাণী নয়, সুন্দরবনের ওপরে নির্ভরশীল ৬৫ লাখ মানুষের জীবিকা, স্বাস্থ্য, বসতি, খাদ্য ও সাংস্কৃতিক তৎপরতাও এর ওপরে নির্ভরশীল। তিনি বলেন, জাতিসংঘের বিজ্ঞান, শিক্ষা ও ঐতিহ্যবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো এবং প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জোট আইইউসিএনের আপত্তি সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার সুন্দরবনের পাশে ৩২০টি শিল্প-কারখানাকে অনুমোদন দিয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয় জনগণের মতামত ও যথাযথ পরিবেশ সমীক্ষা ছাড়া বাংলাদেশ সরকার সুন্দরবনের পাশে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো বড় প্রকল্পের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাতিসংঘ থেকে যেসব কথা বলা হচ্ছে, তা সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে বলা হচ্ছে না। সুন্দরবনের পাশে যেসব কারখানা স্থাপন করা হয়েছে, তা আর সম্প্রসারণ না করার নির্দেশ সরকারের তরফ থেকে দেওয়া হয়েছে। আমরা এসব তথ্য জাতিসংঘের কাছে জমা দেব। আশা করি, তারা আমাদের তথ্যের সঙ্গে একমত হবে।’

জাতিসংঘের এই বিশেষজ্ঞ বলেন, গত বছর বাংলাদেশের উচ্চ আদালত থেকে সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটারের সংবেদনশীল এলাকার (বাফার জোন) মধ্যে কোনো শিল্প-কারখানার অনুমোদন না দেওয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তা অমান্য করে শিল্প-কারখানা অনুমোদনের ব্যাপারে তাদের সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে। পরিবেশের প্রতীক সুন্দরবনে এই বিশৃঙ্খল শিল্পায়ন বিশ্বের পরিবেশের জন্য হুমকি।

জন এইচ নক্স বলেন, অবশ্যই বিশ্বের অন্যান্য মানুষের মতো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির চাহিদা রয়েছে। কিন্তু পরিবেশের ক্ষতি করে অল্প সময়ের অর্থনৈতিক স্বপ্নপূরণের চেষ্টা ‘ভুল জিনিসকে স্বর্ণ ভেবে পেছনে ছোটার মতো’। একটি স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন টেকসই হবে না। তিনি বলেন, সত্যিকার অর্থে টেকসই উন্নয়ন পেতে হলে পরিবেশকে রক্ষা করতে হবে—পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগের বিষয়গুলো আমলে নিতে হবে। সুন্দরবনের পাশে এসব শিল্পায়নের কারণে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাদের কথা শুনতে হবে। তিনি বলেন, যেসব মানুষ ওই উন্নয়ন প্রকল্পগুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, তাদের রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। কিন্তু তাদের টেকসই উন্নয়নের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ঘোষণা দেওয়া উচিত।

জাতিসংঘের এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ম্যানগ্রোভ বন বায়ু ও পানিকে বিশুদ্ধ করতে ভূমিকা রাখছে। যার সুবিধা বনের অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে। পৃথিবীর সর্বত্র ম্যানগ্রোভ বন ছড়িয়ে পড়ুক—এটা আমাদের সবার লক্ষ্য হওয়া উচিত। এর বাইরেও সুন্দরবন আমাদের সবার সামনে দুটি প্রশ্ন তুলে ধরেছে—তা হচ্ছে আমরা কি এমন উন্নয়নের দিকে যাব, যা মানবাধিকার ও পরিবেশ সুরক্ষার কথা বলবে? নাকি আমরা পরিবেশের ক্ষতি করে শিল্পায়নের দিকে এগোব। আমরা কি একটি স্বাস্থ্যকর পরিবেশ চাই, নাকি একটি স্বাস্থ্যকর অর্থনীতি চাই?

জানতে চাইলে তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর ও খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীন বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীরা রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ সুন্দরবনের চারপাশের শিল্প-কারখানার ব্যাপারে যেসব আপত্তি তুলছিল, তার যৌক্তিকতা আবারও প্রমাণিত হলো। আমরা আবারও বলব, সরকার যাতে ওই প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে, চারপাশের সব শিল্প-কারখানার অনুমোদন বাতিল করে। নয়তো সুন্দরবন চিরতরে ধ্বংস হয়ে যাবে, আর এ জন্য এই সরকার দায়ী থাকবে।