২০২১ সাল পর্যন্ত দেশের ৪.৬১% এলাকাকে রক্ষিত বন ঘোষণা করা হয়েছে। ২০২০ সালের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৭%।
দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে এগিয়ে আছে ভুটান। দেশটির রক্ষিত বন ৪৯.৬৭ শতাংশ।
দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম মালদ্বীপে। দেশটির রক্ষিত বনাঞ্চল ২.৩ শতাংশ।
২০২০ সালের মধ্যে দেশের মোট ভূখণ্ডের ১৭ শতাংশকে রক্ষিত বনাঞ্চল করার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য ঠিক রাখতে বিশ্বের প্রায় সব দেশ জাতিসংঘের একটি সনদে স্বাক্ষর করে ওই ঘোষণা দেয়। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বেশ পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।
‘দক্ষিণ এশিয়ার রক্ষিত বনের অবস্থা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা গেছে এ চিত্র। বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট–এ প্রতিবেদনটি চলতি মাসে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণায় বলা হয়, ২০১১ সালে বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশ জাতিসংঘের জীববৈচিত্র্যবিষয়ক সনদ (সিবিডি) অনুযায়ী ওই লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে। এসব দেশের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো। এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও মালদ্বীপে রক্ষিত বনের পরিমাণ ৫ শতাংশের নিচে। বাংলাদেশ ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশের মাত্র ৪ দশমিক ৬১ শতাংশ এলাকাকে রক্ষিত বন করতে পেরেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে এগিয়ে আছে ভুটান, দেশটির রক্ষিত বন ৪৯ শতাংশ ৬৭ শতাংশ। ভারতে রক্ষিত বন ৭ শতাংশ ৫২, শ্রীলঙ্কায় ২৯ শতাংশ ৮৯, পাকিস্তানে ১২ শতাংশ ৩১, নেপালে ২৩ শতাংশ ৬৩, মালদ্বীপে ২ শতাংশ ৩ ও আফগানিস্তানে ৩ শতাংশ ৬৪ শতাংশ।
গবেষক দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার সানশাইন কোস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ গবেষক শরীফ আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে একের পর এক বনকে রক্ষিত হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এগুলো সুরক্ষা দেওয়ার কাজটি এখনো প্রকল্পভিত্তিক রয়ে গেছে। বন বিভাগ ও সরকারের অন্য সংস্থাগুলো কোনো কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারেনি।
প্রকৃতিবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউটের ২০২২ সালের জানুয়ারির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের ১৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ এলাকা রক্ষিত বনভূমি। আর জলভাগের ৭ দশমিক ৯২ শতাংশ এলাকা রক্ষিত অবস্থায় আছে। ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও আফ্রিকার বেশির ভাগ দেশ রক্ষিত বনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পেরেছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে এশিয়ার দেশগুলো।
বাংলাদেশে একের পর এক বনকে রক্ষিত হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এগুলো সুরক্ষা দেওয়ার কাজটি এখনো প্রকল্পভিত্তিক রয়ে গেছে। বন বিভাগ ও সরকারের অন্য সংস্থাগুলো কোনো কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারেনি।শরীফ আহমেদ, জ্যেষ্ঠ গবেষক, অস্ট্রেলিয়ার সানশাইন কোস্ট বিশ্ববিদ্যালয়
প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা রক্ষিত বন ব্যবস্থাপনায় একটি কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার আইনি কাঠামো তৈরি করছি। এসব বন রক্ষায় নিয়মিত তহবিল সৃষ্টি করার কাজও শুরু হয়েছে।’
গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশের রক্ষিত এলাকার ১ শতাংশের কম জায়গা কার্যকর ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা গেছে। বাকি এলাকায় বন্য প্রাণী হত্যা ও পাচার, বৃক্ষ ধ্বংস করাসহ মোট ১৪ ধরনের সমস্যা রয়ে গেছে। রক্ষিত এলাকাগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা থাকলে একে প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থার (আইইউসিএন) সবুজ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
কিন্তু বাংলাদেশের কোনো রক্ষিত বন এখন পর্যন্ত ওই তালিকায় যুক্ত হতে পারেনি। সিবিডি থেকে ২০২০ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে মোট ভূখণ্ডের ৩০ শতাংশ এলাকাকে জীববৈচিত্র্য রক্ষা করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাংলাদেশে রক্ষিত বন রক্ষার বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০–এর মধ্যে আগের লক্ষ্যমাত্রাই পূরণ সম্ভব নয় বলে মনে করছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। এ জন্য বনভূমিগুলোকে পর্যায়ক্রমে রক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা এবং তা সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা। এ জন্য প্রয়োজনীয় জনবল ও তহবিল দেওয়া প্রয়োজন বলেও মনে করছেন তাঁরা।
গবেষণায় বাংলাদেশে রক্ষিত বনভূমিগুলোর একটি সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। সেটি হলো এসব বনভূমির বেশির ভাগের অবস্থান একই অঞ্চলে। মূলত দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের ম্যানগ্রোভ বন ওই রক্ষিত বনভূমি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ রক্ষিত বনাঞ্চল আয়তনে এতটাই ছোট যে তা জীববৈচিত্র্য ধারণের জন্য অপ্রতুল।
গবেষণায় বলা হয়, প্রায় ১৪ ধরনের হুমকির সম্মুখীন এসব বনের জীববৈচিত্র্য। যার মধ্যে বন উজাড় সবার ওপরে। আর সবার নিচে রোগব্যাধির কারণ।
প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থা আরণ্যক ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক রাকিবুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের রক্ষিত বনগুলোর ভেতরে রেলপথ ও সড়ক দিয়ে খণ্ডিত করে ফেলা হয়েছে। এতে সেখানে কোনো বড় বন্য প্রাণী থাকতে পারে না।’ সাম্প্রতিক সময়ে হাতি হত্যার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, বিস্তৃত রক্ষিত বন থাকলে হাতিসহ বড় বড় প্রাণী নিরাপদ আশ্রয় পেত, যা দেশের সামগ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ভূমিকা রাখত।