উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অতি বর্ষণে বগুড়ায় যমুনা নদীর পানি বেড়ে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় নদীর পানি ৪০ সেন্টিমিটার বেড়েছে। আজ রোববার সকাল ছয়টায় যমুনার পানি বিপৎসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
এতে সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা উপজেলার নদীতীরবর্তী নিম্নাঞ্চল এবং দুর্গম চর প্লাবিত হয়েছে। দুর্ভোগে পড়েছে এলাকার হাজার হাজার মানুষ। পানি ঢুকে পড়েছে বসতবাড়িতে। পানি যত বাড়ছে, পানিবন্দী মানুষের দুর্ভোগ তত বাড়ছে। তলিয়ে গেছে পাট, ধানসহ বহু আবাদি ফসল। পানি ঢুকে যাওয়ায় ২০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মানুষজন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটছেন পাউবোর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে।
বগুড়ার পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, যমুনা নদীর সারিয়াকান্দি পয়েন্টে বিপৎসীমা ধরা হয় ১৬ দশমিক ৭০ সেন্টিমিটার। গতকাল শনিবার সকাল নয়টায় পানি ছিল ১৬ দশমিক ৬৭ সেন্টিমিটার। ২৪ ঘণ্টায় ৪০ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে আজ সকাল নয়টায় ১৭ দশমিক ৭ সেন্টিমিটার পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছে। আরও এক সপ্তাহ পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে।
জানা গেছে, যমুনার ঢলে সারিয়াকান্দি উপজেলার চালুয়াবাড়ি, হাটশেরপুর, কাজলা, কর্নিবাড়ি, বোহাইল, চন্দনবাইশা, কামালপুর ও কুতুবপুর ইউনিয়ন এবং সোনাতলা উপজেলার পাকুল্যা ও তেকানীচুকাইনগর ইউনিয়নের কমপক্ষে ৩০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে পাট, আউশ ধানসহ বিস্তীর্ণ ফসলের খেত। পানি বৃদ্ধির সঙ্গে নদীতীরবর্তী এলাকায় দেখা দিয়েছে প্রবল ভাঙন।
দুর্ভোগে পড়েছে সারিয়াকান্দি উপজেলার চালুয়াবাড়ি ইউনিয়নের চর ভাঙ্গুরগাছা, চরদলিকা, চর টবাড়ি, চর উচারপাড়া, চর টিয়ামারি, সুজনেরপাড়া, বিরামের পাচগাছি, বহুলাডাঙ্গা, শিমুলতাইর, হাটশেরপুর ইউনিয়নের চরচকনতিনাথ, দীঘাপাড়া, কাজলাচরের উত্তর ও দক্ষিণ বেনুপুর, জামথৈল, টেংরাকুড়া, পাকদহ, পাকুরিয়া, ঘাঘুয়ারচর, কর্নিবাড়ি ইউনিয়নের মূলবাড়ি, তালতলা, নান্দিনারচর,বানিয়াপাড়াচরের কয়েক শ বসতবাড়ি তলিয়ে গেছে। তলিয়ে গেছে হাজার একর খেতের ফসল। সোনাতলা উপজেলার খাবুলয়িারচর, সরলিয়াচর, ভিকনেরপাড়াচর, মহেশপাড়াচর, জন্তিয়ারচর এবং খাটিয়ামারিরচরের বসতবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। তলিয়ে গেছে কৃষকের পাটসহ নানা ফসল। চাষিরা দ্রুত পাট কেটে নিচ্ছেন। পানিতে ডুবে যাওয়া এলাকার লোকজন উঁচু মাচান তৈরি করে রাত পার করেছেন।
চালুয়াবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, যমুনায় পানি বেড়ে যাওয়ায় তাঁর ইউনিয়নের সব কটি চর প্লাবিত হয়েছে। দুর্ভোগে পড়েছে হাজারো মানুষ।
পাকুরিয়ার চরের ইউপি সদস্য সাজাহান আলী বলেন, যমুনার ঢলে কৃষকের শত শত বিঘা জমির পাট তলিয়ে গেছে। উত্তর ও দক্ষিণ বেনুপুর, জামথৈল, টেংরাকুড়া, পাকদহ, পাকুরিয়া, ঘাঘুয়ারচরসহ দুর্গম এলাকায় পানি ঢুকে পড়েছে।
কর্নিবাড়ির ইউপির চেয়ারম্যান আজাহার আলী বলেন, তাঁর ইউনিয়নে মূলবাড়ি, তালতলা, নান্দিনারচর প্লাবিত হয়েছে। আরও বেশ কয়েকটি চর পানিতে ডুবে হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সোনাতলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শফিকুর ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, যমুনায় পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় তাঁর উপজেলার ছয়টি চর প্লাবিত হয়েছে।
যমুনার ঢলে প্লাবিত হয়েছে সারিয়াকান্দি উপজেলার কামালপুর ইউনিয়নের রোহদহ, ইছামারা, চন্দনবাইশা, নিজ চন্দনবাইশা, ঘুঘুমারি, দক্ষিণ ঘুঘুমারি শেখপাড়া, ফকিরপাড়া, আকন্দপাড়া, শাকদহ, তালুকদারপাড়ার কয়েক শ বসতবাড়ি। এসব গ্রামের পানিবন্দী মানুষ মালামাল, গরু-বাছুর নিয়ে ছুটছেন নিরাপদ আশ্রয়ে। অনেকেই আশ্রয় নিয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে।
কামালপুর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য শাহিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, যমুনার ঢলে কামালপুর ইউনিয়নের ৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ড এবং চন্দনবাইশা ইউনিয়নের আংশিক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। লোকজন বাড়িঘর ছেড়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন।
এদিকে শ্রেণিকক্ষ প্লাবিত হওয়ায় দুর্গত এলাকার প্রায় ২০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সেগুলো হলো রোহদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ফকিরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঘুঘুমারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দক্ষিণ ঘুঘুমারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আদবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কেষ্টিয়ার চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, লক্ষীকোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাকুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রকরতিনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নয়াপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৫৪ কর্নিবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বয়রাকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ময়ূরের চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চরবাটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কুড়িপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ভাঙ্গুরগাছা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এতে করে প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থীর পাঠ ক্ষতিগ্রস্ত পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে।
সারিয়াকান্দি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রফিকুল আলম বলেন, যমুনায় পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় চরাঞ্চলের ৪২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে বেশি ভাগই পাঠদান কার্যক্রম বন্ধের উপক্রম। প্রায় ১৮টি বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া দুটি স্কুল মাদ্রাসার পাঠদানও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
বগুড়া জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা (ডিআরআরও) আজহার আলী মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় সারিয়াকান্দিতে এক হাজার এবং সোনাতলা ও ধুনট উপজেলায় ৫০০ প্যাকেট করে শুকনো প্যাকেট খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। জেলা ত্রাণ ভান্ডারে ৫০০ মেট্রিক টন চাল এবং তিন লাখ টাকা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। জেলা–উপজেলায় কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে।