>• নদীটির নাম আগে ছিল ধানসিদ্ধ
• এখন মরা খাল
• বিষখালী ও গাবখান নদীর মোহনায় বিশাল চর
• নদীর মুখের বড় অংশ ভরাট হয়ে গেছে
• জোয়ারভাটা ঠিকমতো হয় না
নদীর বুকে অল্প পানি। তাতে ঢেউ নেই। শীতকালে পানি শুকিয়ে হাঁটুসমান হয়ে গেছে। হেঁটে পার হওয়া যায়। কবি জীবনানন্দ দাশের প্রিয় ধানসিড়ি নদীর আজ এ অবস্থা। যেখানে কবি আবার ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। কবি রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থে লিখেছেন, ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে—এই বাংলায়/হয়তো মানুষ নয়—হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে।’
জীবনানন্দ দাশ ১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তাঁর নানাবাড়ি ঝালকাঠির রাজাপুরের শুক্তাগড় ইউনিয়নের বামনকাঠি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বিভিন্ন সময় নানাবাড়িতে বেড়াতে আসতেন। সে সূত্রে ধানসিড়ি নদীর প্রেমে পড়েছিলেন।
ঝালকাঠি কবিতা চক্রের সাধারণ সম্পাদক ও জীবনানন্দ গবেষক মু. আল আমীন বলেন, কবি তাঁর মাতুলালয়ের বামনকাঠি গ্রামের দাশবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এ তথ্যটি গবেষক অধ্যাপক সোহরাব হোসেনের লেখায় উঠে এসেছে।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মনোয়ার হোসেন খান বলেন, এ নদীর ধানসিড়ি নামটি জীবনানন্দের দেওয়া। নদীটির আগের নাম ছিল ধানসিদ্ধ। এখনো বয়োবৃদ্ধরা নদীটি ধানসিদ্ধ নামেই জানেন। একসময় এই নদীর তীরবর্তী অঞ্চল ধান-চালের ব্যবসার জন্য বিখ্যাত ছিল। তখন নদীর দুই পারে চাল ব্যবসায়ীরা বড় বড় উনুন তৈরি করে দিনরাত ধান সিদ্ধ করতেন। কলকাতাসহ দূরদূরান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা এসে এখান থেকে চাল সংগ্রহ করে নিয়ে যেতেন। নদীর দুই তীরে ধান সিদ্ধ হতো বলেই এই নদীর নাম হয়েছিল ধানসিদ্ধ। জীবনানন্দের রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থের খ্যাতির কারণে এ নদীটি ধানসিড়ি নামে পর্যায়ক্রমে বদলে গেছে।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, জেলা শহরের অদূরে গাবখান সেতুর পাশ থেকে নেমে কিছু দূর এগোলে চারটি নদীর মোহনা দেখা যায়। বিষখালী, সুগন্ধা, গাবখান ও ধানসিড়ি নদীর মোহনা এটি। এই মোহনার উত্তর-দক্ষিণে ধানসিড়ি নদী বয়ে গেছে। সংযোগস্থল থেকেই ধানসিড়ি নদীর শুরু। বৈদারাপুর থেকে ধানসিড়ি বয়ে গেছে সদরের ছত্রকান্দা গ্রাম হয়ে রাজাপুরের পিংড়ি, হাইলাকাঠি হয়ে মঠবাড়ি পর্যন্ত। শুক্তগড় ইউনিয়নের কোল ঘেঁষে রাজাপুর উপজেলা সদর হয়ে জাঙ্গালিয়া নদীতে মিশেছে। ধানসিড়ি ঝালকাঠি ও রাজাপুরের মধ্যে বন্ধন তৈরি করেছে। কালের প্রবাহে এই নদী আজ মৃতপ্রায়।
সদরের রূপসিয়া গ্রামের সেকান্দার মিয়া বলেন, ‘নদীতে এখন আর আগে মতো গভীরতা নাই। বাবা-দাদার কাছে শুনেছেন এই নদী দিয়া একসময় স্টিমার চলত। তিনি নিজেও দেখেছেন ধানসিড়ি নদী বর্ষার সময় অনেক উত্তাল ছিল। এখন এ নদী মরে গেছে।’
সদরের বৈদারাপুর গ্রামের অমূল্য রতন বলেন, বিষখালী ও গাবখান নদীর মোহনায় বিশাল চর জেগে ওঠায় এ নদীর মুখের বড় অংশ ভরাট হয়ে গেছে। ফলে জোয়ারভাটা ঠিকমতো না হতে পারায় শেষ প্রান্তে গিয়ে নদীটি মরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
সদরের চরকাঠি এলাকার সোহরাব হাওলাদার বলেন, বহু মানুষ আসেন এ নদী দেখতে। তবে অনেকেই এখানে এসে হতাশ হন। এ নদীর তীরের বাসিন্দা হয়ে তিনি গর্ববোধ করেন। এ নদীকে বাঁচাতে খননের দাবি জানান তিনি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ঝালকাঠি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সর্বশেষ ২০১০-১১ অর্থবছরে প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে ধানসিড়ি নদীর উৎসমুখ থেকে সাড়ে সাত কিলোমিটার পশ্চিমে খননের একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ওই সময় সাড়ে চার কিলোমিটার খনন করা হয়েছিল। নিয়মিত বরাদ্দ না পাওয়ায় বাকি সাড়ে তিন কিলোমিটার আর খনন করা হয়নি। ১৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৪৯০ মিটার প্রস্থের ধানসিড়ি নদীর রাজাপুর অংশের অবস্থা বেহাল।
ধানসিড়ি নদীর রাজাপুর বাঘড়ি বাজারের অংশ থেকে প্রায় সাড়ে আট কিলোমিটার খনন করা হবে। ৬৪ জেলার অভ্যন্তরীণ ছোট নদী–খাল–জলাশয় পুনঃখনন প্রকল্পের আওতায় এ নদী খনন করা হবে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা।
পাউবোর ঝালকাঠি জেলা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম আতাউর রহমান বলেন, শিগগিরই খননের দরপত্র আহ্বান করা হবে।