ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাব

ভোলায় প্রাণিসম্পদের বিপুল ক্ষতি

সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, অনেক এলাকা থেকে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা আসেনি। হিসাব এলে ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র জানা যাবে।

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে অনেক গবাদিপশু। গতকাল দুপুরে ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার চরপাতিলা ইউনিয়নের আবদুল্লাপুর বনে
ছবি: প্রথম আলো

বিধবা বিবি মরিয়মের (৪১) বসবাস ভোলার দৌলতখান উপজেলার মদনপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যানবাজার-পাটওয়ারীবাজার সড়কের পাশের টংঘরে। গরু, ছাগল, ভেড়া বর্গা নিয়ে পালন করে কোনো রকমে সংসার চালান তিনি। গত সোমবার জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসের সময় তাঁর দশটি গবাদিপশু মাঠে ছাড়া ছিল। পানি নামার পর দুটি গরু, তিনটি ভেড়া আর খুঁজে পাননি। এগুলো জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এভাবে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে জোয়ার–জলোচ্ছ্বাসের কারণে বিবি মরিয়মের মতো ভোলার আরও বহু মানুষের গবাদিপশু ভেসে গেছে বা মারা গেছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, ইয়াসের প্রভাবে টানা ছয় দিনের (সোম-শনিবার) জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসে আক্রান্ত হয়েছে ভোলার প্রায় ৬৫ হাজার গবাদিপশু–হাঁস–মুরগি। মারা গেছে ৭ হাজার ৪১৪টি পশু-হাঁস–মুরগি। খামারিদের ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি ৪০ লাখ ৫৪ হাজার ৬৮০ টাকার। তবে কৃষকদের দাবি, ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেশি।

স্থানীয় সূত্র জানায়, প্রথম দিনের জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসে মদনপুরের আবু তাহের, আবুল কালাম, আনিসুল হক মাঝি, আবুল বাশার, বাবুল, আপন আলীর একটি করে মহিষ মারা গেছে। মাইনুদ্দিনের একটি ছাগল ও তিনটি ভেড়া, বিবি জোলেখার তিনটি ভেড়া ও একটি ছাগল, আসমার দুটি ভেড়া, জাফরের তিনটি ভেড়া ও দুটি ছাগল, আলমগীরের চারটি ছাগল, আপন আলীর দুটি গরু, সাবদুল্লার পাঁচটি ভেড়া ও আবু মিয়ার চারটি ভেড়া ভেসে গেছে।

গত শনিবার ভোলার মদনপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যানবাজার-পাটওয়ারীবাজার মাটির সড়কের পাশে দুটি মরা গরু পড়ে থাকতে দেখা যায়। এর দুর্গন্ধ আশপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। পথচারীদের নাক চেপে হাঁটতে দেখা যায়। চরফ্যাশন উপজেলার চরপাতিলায়ও একটি গরু ও দুটি ছাগল মরে পড়ে থাকতে দেখা যায়।

মদনপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) প্যানেল চেয়ারম্যান আবদুল খালেক বলেন, ইউনিয়নের দুই শতাধিক গরু-মহিষ, ছাগল-ভেড়া ভেসে গেছে। ভেসে যাওয়া এসব গবাদিপশুর বেশির ভাগই বর্গা নিয়ে পালনকারীদের। এসব পালনকারীর সরকারি সাহায্য দরকার।

চরফ্যাশন উপজেলার সাগর মোহনার ঢালচর ইউনিয়নের গবাদিপশুর মালিকেরা জানান, ঢালচরের নুরুল ইসলামের চরটি, নুর হোসেনের একটি, হাফেজের নয়টি, মোসলেহউদ্দিন মাঝির চারটি, কবির হোসেনের একটি, শাহিন পাটওয়ারীর তিনটি, আবদুর রহিমের দুটি, কামালের তিনটি, ইব্রাহীম মোল্লার দুটি, নজরুল ইসলামের পাঁচটি, নুরে আলমের একটি, নেছারউদ্দিনের সাতটি, মনির হোসেনের দুটি, আল-আমিনের তিনটি, সেলিমের তিনটি, রতনের একটি, সেলিম পাটওয়ারির দুটি, মামুন হাজারীর দুটি, চর নিজামের আবদুল বারেকের দুটি, হারুনের তিনটি, ইব্রাহীমের চারটি গরু ভেসে গেছে। এ ছাড়া ঢালচরের আবুল কাশেম মাঝির দুটি, মানসুর আলমের একটি, চর নিজামের মঞ্জুর মাঝির একটি, মিনারউদ্দিনের দুটি, সফিউল্যাহর দুটি, নজরুলের ছয়টি, বেলু কোম্পানির তিনটি মহিষ ভেসে গেছে। ঢালচরের মনির হোসেনের ১৫টি, চর নিজামের কাশেম মাঝির ৮টি, ফোরকান মাঝির ১৪টি ভেড়া ও খোকনের ১৩টি ছাগল ভেসে গেছে।

স্থানীয় সূত্রের ভাষ্য অনুযায়ী, এ ছাড়া কয়েক হাজার পশু এখনো নিখোঁজ।

ঢালচর ইউপি চেয়ারম্যান আবদুস সালাম হাওলাদার বলেন, ইউনিয়নবাসী বাড়ির আঙিনায় ছাগল-ভেড়া ও হাঁস-মুরগি পালন করেন। আর বনে ছেড়ে দেন গরু-মহিষ। এসব বিক্রির টাকায় তাঁদের সংসার চলে। কিন্তু জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসে এ বছর সব শেষ। ইউনিয়নের এমন কোনো পরিবার নেই, যার হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশুর ক্ষতি হয়নি। চেয়ারম্যান জানান, তাঁর ৩৫টি গরুর মধ্যে ৩০টি ভেসে গেছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, উপজেলার কুকরিমুকরি ইউনিয়নের চর পাতিলার মো. হারুনের একটি গরু ও তিনটি ছাগল জলোচ্ছ্বাসে ভেসে মারা গেছে। প্রায় বিশটি হাঁস-মুরগি ভেসে গেছে মো. ফারুকের। একই গ্রামের আলাউদ্দিনের দুটি গরু ও চারটি ছাগল ভেসে গেছে। দশটি হাঁস, তিনটি ছাগল মারা গেছে বাদশা সরদারের। মো. খোরশেদ আলমের পনেরোটি হাঁস, আটটি মুরগি, চারটি ছাগল ভেসে গেছে।

লালমোহন উপজেলার চর শাহাজালালের মো. নাসিমের পাঁচটি, আবুল কালামের একটি, আনোয়ার হোসেনের একটি, সামসুদ্দিনের একটি, ফিরোজের একটি ভেড়া ও মো. জামালউদ্দিনের দুটি ছাগল মারা গেছে বলে স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে।

মো. নাসিম বলেন, ঘর ভেঙে পড়ে টিনের আঘাতে তাঁর দুটি মহিষের শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। এ ছাড়া বাচ্চু মাঝি ও জসিমউদ্দিনের হাঁসের খামারের দুই হাজার হাঁসসহ প্রায় আড়াই হাজার হাঁস-মুরগি মারা গেছে।

কুকরিমুকরি ইউপি চেয়ারম্যান আবুল হাসেম মহাজন বলেন, চরাঞ্চলের অসহায় নারীরা গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি বর্গা পুষে সংসারে সচ্ছলতা আনেন। কিন্তু এবার জলোচ্ছ্বাসে তাঁদের বেশ ক্ষতি হয়েছে।

মনপুরা উপজেলার দক্ষিণ সাকুচিয়ার চেয়ারম্যান অলিউল্যাহ বলেন, তাঁর ইউনিয়নের শতাধিক গরু-মহিষ ভেসে গেছে জলোচ্ছ্বাসে।

ভোলা জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্র বলছে, ভোলার ৭ উপজেলার ৪১টি ইউনিয়নের ৪ হাজার ১০৯টি গরু, ৩ হাজার ২৫২টি মহিষ, ৯ হাজার ৭৮৮টি ছাগল, ১ হাজার ৩৬৪টি ভেড়া, ১০ হাজার ১৯২টি হাঁস, ৩৬ হাজার ৫৫৪টি মুরগি কোনো না কোনোভাবে জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসে আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ২৮টি গরু, ৫৬টি মহিষ, ৩০টি ছাগল, ২০টি ভেড়া, ৪৩২টি হাঁস, ৬ হাজার ৮৪৮টি মুরগি মারা গেছে। জলোচ্ছ্বাসে ৩ হাজার ৯৩৬ একর গবাদিপশুর চারণভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া ৫৭টি গবাদিপশুর খামারের ৩৮২টি পশু এবং ৫৫টি হাঁস-মুরগির খামারের ২৬ হাজার ৬৮৬টি হাঁস-মুরগি আক্রান্ত হয়েছে। এসব খামারের দানাদার খাদ্য, খড় ও কাঁচা ঘাস নষ্ট হয়েছে প্রায় ৩৭৮ মেট্রিক টন। এতে খামারিদের মোট ১ কোটি ৪০ লাখ ৫৪ হাজার ৬৮০ টাকার ক্ষতি হয়েছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ভোলার উপপরিচালক ইন্দ্রজিৎ কুমার মণ্ডল বলেন, অনেক এলাকা থেকে এখনো ক্ষয়ক্ষতির তালিকা আসেনি। হিসাব এলে ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র জানা যাবে। তিনি জানান, ইয়াসের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের তালিকা করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।