প্রায় এক বছর বৃষ্টি যেন লাগামহীন হয়ে পড়েছে। শীত, গ্রীষ্ম, শরৎ—সব ঋতুতেই চলছে বৃষ্টির দাপট। এবার বর্ষা আসার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির মাত্রা আরও বেড়ে গেছে। মৌসুমি বায়ু সক্রিয় হয়ে ওঠায় জুলাইয়ে শুরু থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হচ্ছে উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলে। এসব এলাকার নদ-নদীর পানিও দ্রুতই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে মধ্য জুলাইয়ে দেশে বন্যা হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ১২ মাসের মধ্যে নয় মাসে দেশজুড়ে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৭ সালের জুন মাসে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। এরপর জুলাইয়ে ৩২, আগস্টে ৩১ দশমিক ৫, সেপ্টেম্বরে ৯ দশমিক ৫, অক্টোবরে ৭৬ দশমিক ২, ডিসেম্বরে ৩৮৫ দশমিক ১ মিলিমিটার স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ছিল শীতের দাপট। শীতের বিদায়ের পর গ্রীষ্ম এলেও এবার ছিল ঝড়-বৃষ্টির দাপট। বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে মাঝারি থেকে তীব্র দাবদাহ বয়ে যায়নি। এর সঙ্গে সাগর থেকে উপকূলের দিকে ধেয়ে আসেনি বড় কোনো ঘূর্ণিঝড়। উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে ছিল প্রায় প্রতিদিনই আকাশ কালো করে ধেয়ে আসা কালবৈশাখী আর বজ্রবৃষ্টি। এ কারণে মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টি হয় দেশজুড়ে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছরের এপ্রিল মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ৩৬ দশমিক ৭, মে মাসে ১৪ দশমিক ৩ এবং জুন মাসে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে।
এ ছাড়া ১ জুন থেকে দেশের ওপর মৌসুমি বায়ুর বিস্তার ঘটতে থাকে। এই মৌসুমি সক্রিয় হয়ে ওঠায় এখন ভারী বৃষ্টি হচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। এ কারণে চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধসের ঘটনাও ঘটেছে।
আবহাওয়াবিদ আরিফ হোসেন বলেন, মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টি আরও কয়েক দিন চলবে। আগামী কাল বৃহস্পতিবারের পর চট্টগ্রাম, বরিশাল ও খুলনায় বৃষ্টির মাত্রা কমতে পারে। তবে উত্তরাঞ্চলে রাজশাহী, রংপুর, উত্তর পূর্বে সিলেট অঞ্চলে বৃষ্টি এরই ধারা চলতে থাকবে।
বৃষ্টির কারণে বন্যার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। আজ বুধবার সকাল নয়টায় তাদের বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুরমা, কুশিয়ারা, সারিগোয়াইন, পুরোনো সুরমা, সোমেশ্বরী, সাঙ্গু ও জদুকাটা নদীর পানির বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা অববাহিকায় নদ-নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি আগামী তিন দিন অব্যাহত থাকতে পারে। অন্যদিকে গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকায় নদ-নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি আগামী দুদিন অব্যাহত থাকতে পারে।
বাংলাদেশ ও ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টায় উত্তর, উত্তর পূর্ব, দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলসহ এর নিকটবর্তী ভারতীয় অংশে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। এ সময় তিস্তা, দুধকুমার, ঘাঘট, সুরমা ও কুশিয়ারার পানি বৃদ্ধি পেতে পারে।
এসব কারণে মধ্য জুলাইয়ে দেশে মধ্য মাত্রার বন্যা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন নদী বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, বাংলাদেশে বন্যার প্রধান কারণ বৃষ্টি। শুধু জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর কারণে আমাদের নদ-নদী অববাহিকায় বৃষ্টি হয়। সেই বৃষ্টিপাতের কারণে এ দেশের নদ-নদীতে পানি বাড়ে। এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এই পানি যখন স্বাভাবিক মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে, তখন বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হবে। কোথাও কোথাও বন্যাও হয়। দেশের তিনটি প্রধান নদী অববাহিকা মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা অববাহিকার ৯৩ শতাংশ এলাকা দেশের বাইরে। বাকি ৭ ভাগ রয়েছে দেশের ভেতর। এসব অববাহিকা দিয়ে উজানের পানির ঢল বাংলাদেশের ভেতর আসে। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার বেশির ভাগ এলাকা পড়েছে ভারত, ভুটান, চীনে। মেঘনা অববাহিকা এলাকার বেশির ভাগ এলাকা ভারতের আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয় রাজ্যে। আর গঙ্গা অববাহিকা চীন, নেপাল, ভারতের বিশাল অংশ বয়ে এসেছে বাংলাদেশে। এসব অঞ্চলে বর্ষাকালে টানা বৃষ্টি হলে নদ-নদীর পানি বেড়ে বন্যা হয়।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, যেভাবে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে উত্তর, মধ্য ও পূর্বাঞ্চলে বন্যা দেখা দিতে পারে। তবে রাজধানী ঢাকার আশপাশের এলাকায় এখনই বন্যা না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধির ওপর এ এলাকার বন্যা নির্ভর করে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আজকের পূর্বাভাসে বলা হয়, গতকাল সকাল ছয়টা থেকে আজ সকাল ছয়টা পর্যন্ত বেশি সবচেয়ে বৃষ্টি হয়েছে চট্টগ্রামে ১৫৯ মিলিমিটার। এ ছাড়া কক্সবাজারে ১০৩, সীতাকুণ্ডে ৯৫, রাজশাহীতে ৩২, রংপুরে ১৭, খুলনায় ১৪, বরিশালে ২৪, ময়মনসিংহে ৬, সিলেটে ৫৭ এবং ঢাকায় ৪৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। অতি ভারী বৃষ্টির কারণে চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধস হতে পারে।