ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় বন্যা বাড়ছে

কুড়িগ্রাম জেলার নদ-নদীর পানি বেড়েই চলেছে। সদর উপজেলার পাঁচগাছি ইউনিয়নের কদমতলী এলাকার বসতবাড়িতে কোমরসমান পানি। নিরাপদ স্থানে রাখা গবাদিপশুর জন্য খড় নিচ্ছেন রাশেদা বেগম। গতকাল দুপুরে। ছবি: মঈনুল ইসলাম
কুড়িগ্রাম জেলার নদ-নদীর পানি বেড়েই চলেছে। সদর উপজেলার পাঁচগাছি ইউনিয়নের কদমতলী এলাকার বসতবাড়িতে কোমরসমান পানি। নিরাপদ স্থানে রাখা গবাদিপশুর জন্য খড় নিচ্ছেন রাশেদা বেগম। গতকাল দুপুরে।  ছবি: মঈনুল ইসলাম

দেশে গত জুন মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু হওয়া বন্যা প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকায় বিস্তৃত হচ্ছে। বন্যায় এখন বাংলাদেশ যে শুধু একাই ভুগছে তা কিন্তু নয়, প্রতিবেশী ভারত, নেপাল থেকে শুরু করে পাকিস্তানের কিছু এলাকাও বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। এমনকি পূর্ব এশিয়ার দেশ চীন থেকে শুরু করে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং জাপানেরও কিছু এলাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে।

তবে অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। এর কারণ, অন্য দেশগুলোর বন্যা ১০ দিনের বেশি স্থায়ী হচ্ছে না। কিন্তু দেশে ১৮ দিন ধরে বন্যা চলছে। আরও ১০ থেকে ১৫ দিন তা চলতে পারে বলে সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে।

বাংলাদেশে বন্যার ধরন ও পরিবর্তন নিয়ে স্কটল্যান্ডের ডান্ডি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক নন্দন মুখার্জি ২০ বছর ধরে গবেষণা করছেন। তাঁর গবেষণায় দেখা গেছে, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা অববাহিকায় গড়ে তোলা প্রায় ৫০০টি বাঁধ, ব্যারাজ (সেচের জন্য অবকাঠামো তৈরি করে পানি নিয়ন্ত্রণ) ও জলবিদ্যুৎকেন্দ্র বিভিন্ন নদীর পানির স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে। বাঁধ, ব্যারাজ ও জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো বড় অবকাঠামোর বেশির ভাগই চীন, ভারত ও নেপালে। ফলে উজানে প্রচুর বৃষ্টি হলে এবং ওই তিন দেশ হঠাৎ করে পানি ছেড়ে দিলে বাংলাদেশের নদ-নদীতে প্রচুর পানি চলে আসছে। 

২০১৯ সালে জাতিসংঘের দুর্যোগ ঝুঁকি পুরস্কার পাওয়া নন্দন মুখার্জি প্রথম আলোকে বলেন, পদ্মা ও তিস্তা অববাহিকায় কী ধরনের এবং কতটি অবকাঠামো আছে, তা মোটামুটি জানা গেলেও ব্রহ্মপুত্র এবং বরাক নদের ওপর নির্মাণ করা অবকাঠামোর তথ্য সেভাবে পাওয়া যায় না। তাই ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার বন্যা ব্যবস্থাপনার জন্য চীন, তিব্বত, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তথ্যবিনিময় জরুরি। একই সঙ্গে পানি ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত সহযোগিতার সম্পর্ক তৈরি করা দরকার।

গঙ্গা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা অববাহিকার মৌসুমি বায়ু, বৃষ্টি, পানির প্রবাহের ধরন বিশ্লেষণ করে নন্দন মুখার্জি দেখিয়েছেন, ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা অববাহিকায় ঘন ঘন বন্যা হচ্ছে এবং আগের চেয়ে বেশি এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। যে কারণে কুড়িগ্রাম, জামালপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট ও গাইবান্ধায় দু-তিন বছর পরপর বড় বন্যা হচ্ছে। 

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্যা ও পানি ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সাইফুল ইসলামের করা গবেষণাতেও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় বন্যা বেড়ে যাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। গত ডিসেম্বরে প্রকাশিত তাঁর গবেষণায় বলা হয়েছে, মূলত বিশ্বের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মৌসুমি বায়ু আগের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠছে। এতে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে বেশি বৃষ্টি ঝরাচ্ছে। এই গবেষণা বলছে, কুড়িগ্রাম থেকে মানিকগঞ্জ পর্যন্ত দেশের উত্তর থেকে মধ্যাঞ্চলে বন্যার তীব্রতা আগামী বছরগুলোতে আরও বাড়তে পারে। ফলে এই অঞ্চলের বন্যা ব্যবস্থাপনার জন্য আলাদা প্রস্তুতি নিতে হবে। 

বন্যা এলাকার বদল

ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা অববাহিকায় বন্যার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় নতুন বিপদ দেখছেন সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞরা। সাধারণত ব্রহ্মপুত্রের পানি বাংলাদেশে প্রবেশ করে কুড়িগ্রাম দিয়ে আর তিস্তার পানি লালমনিরহাট দিয়ে। এই দুই অববাহিকার পানি একসঙ্গে বাড়লে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী, লালমনিরহাট, জামালপুর, রংপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ থেকে মানিকগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় বন্যা দীর্ঘস্থায়ী রূপ নেয়। পানি নামতেও বেশি সময় লেগে যায়।

এক যুগ আগেও এই দুই অববাহিকার পানি আলাদা সময়ে বাড়ত। আর পানি তিন থেকে সাত দিনের বেশি থাকত না। কিন্তু এক যুগ ধরে এই দুই অববাহিকার পানি একযোগে বাড়ছে। ফলে বন্যার স্থায়িত্বও বাড়ছে। 

এ ব্যাপারে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ব্রহ্মপুত্রের পানি এবার দীর্ঘ সময় ধরে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। আবার তিস্তার পানিও একই সময়ে বাড়ছে। ফলে পানি নামতে পারছে না। 

একসময় দেশের নদীভাঙন এলাকা ছিল সিরাজগঞ্জ, বগুড়া ও মানিকগঞ্জ জেলা। পদ্মাপারের শরীয়তপুর, চাঁদপুর ও রাজবাড়ীতেও ভাঙন হতো। কিন্তু মৌসুমি বায়ুর ধরন বদলে যাওয়ায় ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বেড়ে যাওয়ায় সামনের দিনগুলোতে উত্তরাঞ্চলের গাইবান্ধা, জামালপুর ও কুড়িগ্রামের পাশাপাশি দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে ভাঙন বাড়বে বলে নন্দন মুখার্জির গবেষণায় উঠে এসেছে।

এ ব্যাপারে বুয়েটের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এত দিন বন্যা ব্যবস্থাপনার বিষয়টিকে যেভাবে দেখা হয়েছে, তা বদলাতে হবে। বন্যার এলাকাগত যে পরিবর্তন হচ্ছে, তা বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে। 

এদিকে আগামী ১৪ দিনের জন্য সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ১৭ জুলাই পর্যন্ত কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী, রংপুর, বগুড়া, নাটোর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও মানিকগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে। আবার ২০ থেকে ২১ জুলাইয়ের দিকে নদীর পানি বেড়ে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। 

ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় থেকে গতকাল জানানো হয়েছে, এখন পর্যন্ত বন্যায় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া বন্যায় ২ লাখ ৭০ হাজার পরিবার অর্থাৎ প্রায় ১৩ লাখ মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় আছে। ১৭টি জেলায় এখন বন্যার পানি আছে। 

দেশের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, ‘এটা এখন প্রমাণিত যে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার জেলাগুলোতে বন্যা বাড়ছে। কিন্তু আমরা ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতির বিষয়টিকে যেভাবে এত দিন গুরুত্ব দিয়েছি, বন্যাকে ততটা দিইনি। একটি জাতীয় কমিশন গঠন করে সামগ্রিক পরিকল্পনার আওতায় দেশের বন্যা ব্যবস্থাপনাকে নিয়ে আসার সময় হয়েছে এখন।’