বিচিত্র উদ্ভিদে ঠাসা অনন্য উদ্যান

ধাত্রীফুল। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন। রাগকাট নামেও পরিচিত। গুল্মজাতীয় গাছটি সিলেট, কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামে জন্মে। ছবি: লেখক
ধাত্রীফুল। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন। রাগকাট নামেও পরিচিত। গুল্মজাতীয় গাছটি সিলেট, কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামে জন্মে।  ছবি: লেখক

২০০৭ সাল। ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন। সংগ্রহ ততটা সমৃদ্ধ নয়, তবে কিছু অচেনা উদ্ভিদ প্রজাতি আছে।

২০১৮ সাল। ব্রহ্মপুত্রের পাড় লাগোয়া সেই বাগানে নানা প্রজাতির গাছপালা যেন উপচে পড়ছে। একসময়ের হতশ্রী উদ্যান এখন প্রায় ১ হাজার ৫০০ প্রজাতির বিচিত্র উদ্ভিদে সমৃদ্ধ। এত সব দুর্লভ জাতের উদ্ভিদ এল কোথা থেকে? কে আছেন এর পেছনে? এই উদ্যানশিল্পীর সন্ধান পেতে কষ্ট হয়নি। তিনি অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান।

১৯৮২ সালে এই উদ্যানের দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রপ বোটানি বিভাগের কাছে ন্যস্ত হয়। মোস্তাফিজুর রহমান ক্রপ বোটানির বিভাগীয় শিক্ষক হিসেবে ১৯৯৬ সালে দুই বছর মেয়াদে বাগানটির কিউরেটরের অতিরিক্ত দায়িত্ব পান। এর পর থেকে বাগানের প্রতি তাঁর ভালোবাসা বেড়ে যায়। ফলে কিউরেটরের দায়িত্ব শেষ হওয়ার পরও বাগান নিয়ে পড়ে থাকেন।

মাত্র ২৫ একর পরিসরের উদ্যানটি ঘুরে দেখে বুঝতে বাকি থাকল না, এটি দেশের অন্য আঞ্চলিক বোটানিক্যাল গার্ডেনগুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা একটি উদ্যান। উদ্যানটির সংগ্রহ বাড়াতে অধ্যাপক মোস্তাফিজ প্রায় ২১ বছর ধরে সারা দেশের বনবাদাড় চষে বেড়িয়েছেন। ধরনা দিয়েছেন বহু লোকের দুয়ারে। এই অধ্যাপকের কাছে উদ্যানে কী আছে—তা জরুরি নয়, কী নেই—সেটাই জরুরি। সংগ্রহের দীর্ঘ তালিকায় চোখ রাখলে কথাটি মোটেও বাহুল্য মনে হবে না।

স্বাভাবিকভাবে গাছপালার দৈহিক গঠন, সৌন্দর্য, স্বভাব, আবাসন, গুরুত্ব ইত্যাদি বিষয়ে লক্ষ রেখে শ্রেণিবিন্যাস করে উদ্যানের সর্বত্র উদ্ভিদ সংরক্ষণ করা হচ্ছে। উল্লেখযোগ্য সংগ্রহের মধ্যে ৫০০ প্রজাতির ঔষধি উদ্ভিদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জিমনোস্পার্ম জাতীয় ২৭ প্রজাতির বিরল গাছপালা সাইকাস বাগানে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো সাইকাস সিরসিনালিস, সাইকাস রামফি, জিঙ্কগো বিলোবা, বাঁশপাতা, জুনিপেরাস, অরোকেরিয়া, স্ট্যানজেরিয়া ইরিওপাস ইত্যাদি। পামবাগানেও আছে ২৭ প্রজাতির পামজাতীয় উদ্ভিদ।

উদ্যানে পরিকল্পিতভাবে বৈচিত্র্যময় ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ বিষয়ে শিক্ষা, গবেষণা ও পরিদর্শনের জন্য ২০০৬ সালের দিকে একটি ছোট আকারের সুন্দরবন গড়ে তোলা হয়েছে। তাতে লতা হোকোচ-কাঁটা, সিংড়া, কিরপা, গেওয়া, আমুর, পশুর, খলশি, কাঁকড়া, গরান, গুটিয়া, ভোরা, খামো, কেওড়া, সুন্দরী, সাদা বাইন, বাইন, হেতালসহ প্রায় ২০ প্রজাতির উদ্ভিদ সংরক্ষিত আছে।

প্রায় ৩০০ প্রজাতির নান্দনিক ফুল বাগানটিকে বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে। এর মধ্যে স্বর্ণ–অশোক, রাজ–অশোক, পাখিফুল, অনন্তলতা, কমব্রিটাম গোল্ডেন সাওয়ার, রুদ্রপলাশ, স্কারলেট কর্ডিয়া, হেলিকোনিয়া ইত্যাদি অন্যতম। আছে দেশের বিভিন্ন জলাঞ্চল থেকে সংগৃহীত ৩২ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদের আকর্ষণীয় সংগ্রহ। এর মধ্যে কোনো কোনোটি বেশ দুর্লভ ও বিপন্ন।

সুবিশাল ও বর্ণাঢ্য এই বৃক্ষভান্ডার দেখে অনুমান করা যায়, কাজটি মোটেও সহজ ছিল না। সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা প্রায় সব কটি বনাঞ্চল, বিভিন্ন বোটানিক্যাল গার্ডেন, বৃক্ষমেলা ও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য নার্সারি থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে এই উদ্ভিদগুলো।

এই ফাঁকে মোস্তাফিজুর রহমান তাঁর সহযোগীদের নিয়ে উদ্যানে এ পর্যন্ত ৩০ প্রজাতির অপ্রচলিত ও কম প্রচলিত দেশীয় ফল এবং প্রায় ১৮ প্রজাতির বিদেশি ফলের দুর্লভ সংগ্রহও গড়ে তোলেন।

সরকারের কোষাগার থেকে টাকা মিলবে কি মিলবে না, এই তোয়াক্কা না করেই শুরু হয়েছিল কাজ। অবশ্য প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে কিছু সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অর্থানুকূল্য পেয়েছেন মোস্তাফিজ। একটি ছাদহীন পরিত্যক্ত ভবন ও দুটি গ্লাস হাউস বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নে পর্যায়ক্রমে মেরামত ও সংস্কার করে একটিতে ক্যাকটাস হাউস করা হয়েছে। দুটি গ্লাস হাউসের একটিতে বিরল ও গুরুত্বপূর্ণ গুল্ম ও তৃণজাতীয় বাহারি গাছপালা, অন্যটিতে ঔষধি গাছ সংরক্ষণ করা হয়। বাগানে ক্যাকটাস হাউস, ঔষধি উদ্ভিদ সংগ্রহশালা, অর্কিড ঘর, বাঁশবাগান, নার্সারিসহ আরও প্রদর্শনী হাউস রয়েছে।

মোস্তাফিজুর রহমান নিজের বৃক্ষ অনুরাগী হয়ে ওঠার শুরুটা স্মরণ করলেন এভাবে, ‘মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে আমরা কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় যুবক মিলে একটি সমাজকল্যাণ সংঘ গড়ে তুলি। আমি তখন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষ কৃষি অনুষদের ছাত্র। এই সংঘের আওতায় অন্যান্য সমাজকল্যাণমূলক কাজের পাশাপাশি বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি হাতে নিই আমরা। ৭০ মাইল দূরে জেলা সদর দিনাজপুর, সেখান থেকে নানান জাতের গাছের চারা সংগ্রহ করে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও দুটি বাজারের ফাঁকা জায়গায় রোপণ করি। ছাত্রজীবনে গাছের সঙ্গে ওই সম্পৃক্ততাই আমার জীবনকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে বলে আমার বিশ্বাস।’

এখন এই উদ্যানে সংরক্ষিত গাছপালার তথ্য ও পরিচিতিমূলক নামফলকগুলো সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষকের ভূমিকা পালন করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও শিক্ষার্থীরা এই বোটানিক্যাল গার্ডেনে সংরক্ষিত বিভিন্ন শ্রেণির উদ্ভিদ নিয়ে নানা ধরনের গবেষণা করছে। উদ্ভিদবৈচিত্র্য, বিশেষত বনজ উদ্ভিদের পরিচিতি, শ্রেণিবিন্যাস, শনাক্তকরণ, ফুল ও ফলের গঠন ও বিকাশ, প্রজনন–বৈশিষ্ট্য, ফুল ও ফল ধারণের সময়কাল ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণা করা হয়। গবেষণা হচ্ছে বিরল ঔষধি গাছের রাসায়নিক ও ঔষধি গুণ এবং তার ব্যবহার সম্পর্কেও।

কৃতী এই উদ্ভিদ সেবকের জন্ম ১৯৫০ সালের জুন মাসে, দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার কালিকাপুর মণ্ডলপাড়া গ্রামে। ১৯৭৬ সালে তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন। ২০১৬ সালে অবসরে যান। এই অবসর কেবল ক্লাসের পাঠদানের ক্ষেত্রে কার্যকর। তিনি সক্রিয় আছেন তাঁর জগতে। উদ্যানচর্চার পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন প্ল্যান্ট কনজারভেশন অ্যান্ড রিসার্চ ফাউন্ডেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান। সারা দেশের বোটানিক্যাল গার্ডেনগুলো যেন একটি ছাতার নিচে এসে কাজ করতে পারে, সেই লক্ষ্যে কাজ করে চলেছেন অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান।