>• বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি
• ভূকম্পন হওয়ায় নতুন ঘরবাড়িতে ফাটল দেখা দিচ্ছে
• লোকজন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন
• আশপাশের গ্রামে বিশুদ্ধ পানির সংকট
• গ্রামবাসী বলছেন, কম্পনের কারণে এলাকার বাড়িঘরে ফাটল দেখা দিয়েছে
• খনির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামের বাসিন্দারা মিলে গড়ে তুলেছেন বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি এলাকায় ২০ গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত কমিটি
দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির অধিগ্রহণ করা এলাকার বাইরের কয়েকটি গ্রামে নিয়মিত জোরালো ভূকম্পন হচ্ছে। গ্রামবাসী বলছেন, কম্পনের কারণে এলাকার বাড়িঘরে ফাটল দেখা দিয়েছে। লোকজন ঝুঁকি নিয়ে এসব ঘরে থাকছে। অন্যদিকে খনির পূর্ব পাশের গ্রামগুলোর নলকূপে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এতে এলাকায় বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিচ্ছে।
গত রোববার হামিদপুর ইউনিয়নে খনির পাশের চারটি গ্রাম ঘুরে এবং এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নির্দিষ্ট কোনো সময়ে না, হঠাৎ পুরো এলাকা প্রচণ্ডভাবে কেঁপে ওঠে। কিছুক্ষণ স্থায়ী এই কম্পন ভূমিকম্পের মতো ঝাঁকুনি দেয়। খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের কারণে গ্রামের বাড়িগুলো খনির দিকে খানিকটা হেলে যাচ্ছে। ফলে বাড়ির দেয়াল, মেঝে, সড়কে ফাটল দেখা দিয়েছে।
খনির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত আশপাশের গ্রামের বাসিন্দারা মিলে গড়ে তুলেছেন বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি এলাকায় ২০ গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত কমিটি। কমিটির দেওয়া তথ্যমতে, অধিগ্রহণ করা এলাকার বাইরে ৯টি গ্রামের বেশ কিছু বাড়িঘরে ফাটল দেখা দিয়েছে। গ্রামগুলো হলো শিবকৃষ্ণপুর, বৈগ্রাম, কাশিয়াডাঙ্গা, মৌপুকুর, পাঁচঘরিয়া, বৈদ্যনাথপুর, বাঁশপুকুর, পাতিগ্রাম ও কালুপাড়া।
কমিটির নেতা মো. মশিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এলাকার মানুষ কয়লা উত্তোলনের বিরোধিতা করছে না। কিন্তু ঘরবাড়িতে ফাটল দেখা দেওয়া ও পানির সংকট হওয়ার বিষয়টি সরকারকে দেখতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো ন্যায্যমূল্যে অধিগ্রহণ করার বিষয়ে আলোচনা চলছে।
বাঁশপুকুর গ্রামের কৃষক সুলতান মাহমুদের বাড়ির প্রতিটি কক্ষে বড় ফাটল। তিনি বলেন, ‘পেট্রোবাংলার কেউ (খনি কর্তৃপক্ষ) আসি থাকব এক রাত এমন ঘরে? একটা ঘর ভাইঙা মানুষ মরলে কে দায় নেবে? এবার বর্ষায় এমন যে কোনো ঘর ভেঙে পরতে পারে।’
দেখা যায়, বৈদ্যনাথপুর থেকে বাঁশপুকুর গ্রাম পর্যন্ত আড়াআড়ি একটি ফাটল চলে গেছে। এই ফাটলটির কারণে বাঁশপুকুর গ্রামের বাচ্চু মিয়ার বাড়ির সামনের একটি পুকুরের পানি শুকিয়ে গেছে। ঘরবাড়ির পাশাপাশি রাস্তায় ফাটল দেখা দেওয়ায় গ্রামের মানুষ এখন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।
গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বছর ফাটল ধরা প্রতিটি ঘর সংস্কারের জন্য খনি কর্তৃপক্ষ ৯ হাজার করে টাকা দিয়েছিল। কিন্তু ভূকম্পন বন্ধ না হওয়ায় অনেক নতুন ঘরবাড়িতে ফাটল দেখা দিচ্ছে। পুরোনো ফাটল থাকা বাড়িগুলোর ফাটল আরও বেড়েছে।
খনির আশপাশের গ্রামগুলোতে বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। গ্রামবাসীর অভিযোগ, খনির কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে
গেছে। পানির সংকট নিরসনে গভীর নলকূপ বসিয়ে পাইপের মাধ্যমে গ্রামে পানি সরবরাহ করার দাবি জানান তাঁরা।
এসব বিষয়ে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিএমসিএল) মহাব্যবস্থাপক (সারফেস অপারেশন) মো. সাইফুল ইসলাম সরকার প্রথম আলোকে বলেন, খনির ভেতরে বিস্ফোরণ ঘটানো, ছাদ ধসের কারণে ভূকম্পন হতে পারে। সেটি খুব
মৃদু ও বিরল। খনির ইনফ্লুয়েন্স এলাকার বাইরে ফাটল হলে সেগুলোর ক্ষতিপূরণ অবশ্যই দেওয়া হবে। আর পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার সঙ্গে খনির কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
পুনর্বাসন প্রকল্পে থাকেন না ক্ষতিগ্রস্তরা
কয়লাখনির ক্ষতিগ্রস্ত ভূমিহীনদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পের কক্ষে জায়গা–স্বল্পতার কারণে অনেক পরিবার সেখানে থাকছে না। পুনর্বাসন প্রকল্পটি পার্বতীপুর উপজেলার হামিদপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ পলাশবাড়ী এলাকায় অবস্থিত। ১০ শতক বা তার নিচে যাঁদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তাঁদের ভূমিহীন বিবেচনা করে এই পুনর্বাসন প্রকল্পে কক্ষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
৩০ একর জমির ওপর একতলাবিশিষ্ট মোট ৬৪টি পাকা বাড়ি রয়েছে এখানে। প্রতিটি বাড়িতে কক্ষ আছে পাঁচটি। প্রত্যেক পরিবারকে একটি কক্ষ দেওয়া হয়েছে। মোট ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ৩১৮টি। মোট পাঁচটি পরিবারের জন্য একটি নলকূপ, একটি গোসলখানা ও দুটি শৌচাগারের ব্যবস্থা আছে।
সম্প্রতি পুনর্বাসন প্রকল্প এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বেশ কিছু কক্ষ ফাঁকা। এগুলোর বাসিন্দারা ঘরে তালা দিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন। যেসব ঘরে বাসিন্দা রয়েছে, সেগুলোর সামনে-পেছনে টিন দিয়ে খুপরি ধরনের ঘর তোলা হয়েছে।
পুনর্বাসন প্রকল্পের বাসিন্দারা বলেন, কক্ষগুলোর ছাদ চুইয়ে পানি পড়ে। একেকটি পরিবারের সদস্য তিন থেকে ছয়জন। পুরো পরিবার নিয়ে একটি কক্ষে বসবাস করা কষ্টকর। তাই বাধ্য হয়ে কক্ষের সামনে বা পেছনের ফাঁকা জায়গায় টিন দিয়ে নিজেদের মতো করে ঘর তুলেছেন।
প্রকল্পের বয়োজ্যেষ্ঠ বাসিন্দা মোখলেসুর রহমান বলেন, পুরো পরিবারের জন্য একটি কক্ষ। ছেলে, ছেলের বউ, নাতি-নাতনি নিয়ে থাকার সমস্যা হয়। এক কক্ষে থাকার কষ্টের জন্য বরাদ্দ পাওয়া অনেক পরিবার প্রকল্প এলাকায় থাকছে না।