প্রকৃতি

বাংলার অন্তরঙ্গ বৃক্ষ করঞ্জা

রাজধানীর দোয়েল চত্বর এলাকায় আছে করঞ্জা ফুলের গাছ
ছবি: লেখক

করঞ্জা নামটির সঙ্গে অনেকেই করমচা ফলের তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। নাম দুটি খুব কাছাকাছি হওয়ায় এ বিপত্তি। আদতে দুটি একেবারেই আলাদা গাছ। প্রথমোক্তটি বুনো গাছ আর দ্বিতীয়টি ফলের জন্য চাষ করা হয়। বুনো হওয়ার কারণে করঞ্জা আমাদেরও অনেকটাই অচেনা।

সে তুলনায় করমচা বেশি পরিচিত। করঞ্জা ঢাকায় খুব বেশি দেখা যায় না। দোয়েল চত্বরসংলগ্ন কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউয়ে অপরিণত দু-একটি গাছ আছে। আর আছে প্রধান বিচারপতির বাসভবনসংলগ্ন পূর্ব পাশের দেয়ালে। এ গাছগুলো বেশ পুরোনো। মিরপুর জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানেও কয়েকটি গাছ আছে।

জানা যায় যে একসময় ঢাকার পতিত জায়গা ও বিভিন্ন জলার ধারে প্রচুর পরিমাণ দেখা যেত। পরবর্তী সময়ে উন্নয়নের নামে ‘অবাঞ্ছিত’ বিবেচনায় অধিকাংশ গাছ কেটে ফেলা হয়।

অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা তাঁর শ্যামলী নিসর্গ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘মিন্টো-বেইলি রোড অঞ্চলের কোনো কোনো বাড়ির সীমানায়, মতিঝিল ও কারওয়ান বাজারের জলাভূমির কিনারে এবং শহরের পোড়ো জমিতে করঞ্জা প্রায়ই চোখে পড়ে।’ কিন্তু উল্লিখিত আবাসে এখন গাছগুলো নেই বললেই চলে। এদের প্রিয় আবাসের তালিকায় পাহাড় ও জলাধার দুটোই আছে।

এ কারণে উপকূলীয় এলাকায় যেমন দেখা যায়, তেমনি পাহাড়েও সহজলভ্য। সিলেট শহরে প্রচুর পরিমাণ করঞ্জা আছে। গাছটি গঠনশৈলীর দিক থেকে অনন্য। ঘনবদ্ধ পাতার নিবিড় ছায়ায় বেশ সুশ্রী এ গাছ। ফুলের শোভা স্নিগ্ধ ও মায়াময়। মনে পড়ে, এ গাছের শুকনো ফল দিয়ে ছেলেবেলায় পুকুরে অনেক ব্যাঙলাফ খেলেছি!

এ অঞ্চলের নিজস্ব ও আদি বৃক্ষ হওয়ায় মধ্যযুগের কাব্যেও গাছটির উল্লেখ পাওয়া যায়। কবি কঙ্কণ চণ্ডী লিখেছেন:

‘মাণ্ডার পাণ্ডার কাটে শতমূলী।

ফলহীন আম জাম কাটিল কুলী॥

তমাল অর্জুন করঞ্জা বন।

কাটে কোকিলাক্ষ চিরতা কানন॥’

করঞ্জা (Pongamia pinnata) মাঝারি আকৃতির পত্রমোচী গাছ, কাণ্ড ধূসর, গাঁটযুক্ত, মসৃণ ও খাটো। শাখা-প্রশাখা অনেক এবং ভূমুখীন, এ কারণে মাথা ছড়ানো। যৌগিক পত্র বৃহৎ, একপক্ষল, শীর্ষ পত্রিকা বিজোড়। কচি পাতা উজ্জ্বল সবুজ, কোমল এবং নমনীয়, পরিণত পাতার গ্রথন দৃঢ় ও কালচে সবুজ বর্ণের। এ গাছ ঘনবদ্ধ পাতায় ছায়ানিবিড়। বসন্তের শেষে নতুন পাতার প্রাচুর্যে ভরে ওঠে গাছ। পাতা গজানোর পরপরই ফুল ফুটতে শুরু করে।

ছোট ছোট মঞ্জরি পাংশু ফুলের দৈন্যে নিষ্প্রভ হলেও পাতার ঘন সবুজ পটভূমিতে বেশ নান্দনিক হয়ে ওঠে। ফুলের গড়ন শিমফুলের মতো। ফল ছোট, চ্যাপটা, ঈষৎ বাঁকানো ও কঠিন। শিশুরা শুকনো ফল পানিতে ছুড়ে মেরে ব্যাঙ ব্যাঙ খেলে। ফল পরিণত হতে প্রায় এক বছর সময় লাগে।

বীজ দূরবাহী, স্রোতের টানে অনেক দূর অবধি ছড়িয়ে যেতে পারে। একসময় বীজতেল জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বাকলের আঁশ থেকে দড়ি তৈরি হয়। কাঠ শক্ত হলেও দারুমূল্যহীন। আদি আবাস চীন, মালয়, শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়াসহ ভারত-বাংলাদেশ। বীজ ছাড়া কলমেও বংশবৃদ্ধি সম্ভব।

মোকারম হোসেন, প্রকৃতি পরিবেশবিষয়ক লেখক