বন্যা নিয়ন্ত্রণে ‘বালির বাঁধ’

দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী মাটি দিয়ে বাঁধটি মেরামতের কথা। কয়েক দফা চিঠি দিয়েও ঠিকাদারের সাড়া পায়নি পাউবো।

খুলনার কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের গাতির ঘেরি এলাকার ভাঙা বাঁধ মেরামত করতে ব্যবহার করা হচ্ছে বালু। সম্প্রতি কয়রায়

বাংলা ভাষার প্রচলিত একটি বাগ্‌ধারা ‘বালির বাঁধ’। ‘ক্ষণস্থায়ী’ কোনো কিছু বোঝাতে যার ব্যবহার হয়। অথচ খুলনার কয়রা উপজেলায় বন্যা নিয়ন্ত্রণের স্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে নির্মাণ করা হচ্ছে ‘বালির বাঁধ’। ভাঙা বাঁধ মেরামতে বালু ব্যবহার করায় বাঁধটির স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ১ হাজার ২০০ মিটার অংশ মেরামতের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা। দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী মাটি দিয়ে বাঁধটি মেরামতের কথা। সেখানে বালু ব্যবহার করায় বিব্রত কাজ তদারকির দায়িত্বে থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারাও। সংস্থাটি কয়েক দফায় ঠিকাদারকে চিঠি দিলেও এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি।

চলতি বছরের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে ভেঙে গিয়েছিল কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের গাতির ঘেরি এলাকার শাকবাড়িয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। ভাঙা বাঁধটুকুর দূরত্ব প্রায় ৪৫ মিটার। তিন মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও সেটি এখনো মেরামত করা হয়নি। ফলে প্রতিদিনই জোয়ারে সাগরের নোনা পানি ঢুকছে গাতির ঘেরি গ্রামে। পুরো গ্রামটিই দিনে দুবার জোয়ারের পানিতে ডুবছে। মানুষ এলাকা ছেড়ে রাস্তার ওপর আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানেই পলিথিন ও গোলপাতা দিয়ে তৈরি ছাপরা ঘরে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

গত ৩০ আগস্ট সরেজমিনে দেখা যায়, ভাঙা বাঁধের দুই দিকে লোকালয়ের পাশে বালু ফেলা হয়েছে। কিছু জায়গায় ওই দিনই বালু ফেলা হয়। পানি থাকায় তাতে পা পড়তেই পা বালুর মধ্যে দেবে যাচ্ছিল। উত্তর পাশে পড়ে ছিল একটি এক্সকাভেটর (ভেকু মেশিন)। কিন্তু তাতে কেউ ছিলেন না। উত্তর পাশে বাঁধের দুই পাশে মাটি দিয়ে মাঝখানে বালু ফেলা হয়েছে।

দেখা যায়, ভাঙা বাঁধের ঠিক বিপরীত দিকে সুন্দরবনের পাশেই শাকবাড়িয়া নদী থেকে একটি ড্রেজার দিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। ওই বালু বাঁধ মেরামতে ফেলা হবে বলে জানান স্থানীয় লোকজন। ভাঙা স্থানে কোনো কাজ না করে দুই দিকে বাঁধের কাজ করা হচ্ছে। এ কারণে জোয়ারের পানি প্রবেশ করছে লোকালয়ে। এক ঘণ্টার বেশি সময় ওই এলাকায় অবস্থান করেও কাজের দায়িত্বে থাকা কাউকে পাওয়া যায়নি।

এলাকাবাসী বলেন, বালু দিয়ে বাঁধ করার কারণে দু–এক বছরের মধ্যে সেটি আবারও ভেঙে যাবে। ইয়াসের ক্ষতি কাটিয়ে উঠে সবাই যখনই কেবল একটু ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করবে, তখনই আবার ভেসে যাবে সবকিছুই। যেমনটি হয়েছে আইলার পর। ২০০৯ সালে আইলায় একই স্থানের বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। প্রায় দুই বছর পানিবন্দী ছিল এলাকা। এক যুগ পর আবারও সেখান দিয়েই ভেঙে গেছে। ঘুরে দাঁড়ানো মানুষগুলো আবারও সর্বস্বান্ত হয়েছেন।

পাউবো সূত্রে জানা গেছে, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো–অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে ওই কাজটি বাস্তবায়ন করছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। তদারকির দায়িত্বে আছে পাউবো। ৩ কোটি ৩০ লাখ ৫৫ হাজার টাকা ব্যয়ে ১ হাজার ২০০ মিটার বাঁধ মেরামতের কাজ পেয়েছে ঢাকার মেসার্স আরাধনা এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। দরপত্র অনুযায়ী ভাঙা বাঁধের স্থান মাটি দিয়ে মেরামত করতে হবে। বাঁধ মেরামত হয়ে গেলে তা টেকসই করতে নদীর কিনারে বালিভর্তি জিও ব্যাগ ফেলতে হবে। এ ছাড়া কিছু ডাম্পিং বস্তাও ফেলা হবে ভাঙন স্থানে। গত ৩ জুন ঠিকাদারকে কাজের দায়িত্ব বুঝে দেওয়া হয়। আজ ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা। কিন্তু তিন মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এসবের কিছুই করা হয়নি।

কয়রা উপজেলার ওই অংশটি পড়েছে পাউবোর সাতক্ষীরা পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগ-২–এর আওতায়। কাজের মান ও ধীরগতির জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কয়েক দফা চিঠি দিয়েছে পাউবো। ওই বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাশিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বালু দিয়ে কাজ না করে দরপত্র অনুযায়ী কাজ করা, দ্রুত সময়ের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করাসহ বিভিন্ন কারণে দফায় দফায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেওয়া হয়েছে ও হচ্ছে। এরপরও কাজের কোনো অগ্রগতি নেই। ব্যাপারটি সবাইকে হতাশ করছে।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন সাতক্ষীরার মো. আবদুস সবুর নামের এক ঠিকাদার। জানতে চাইলে তিনি দাবি করেন, বালু ফেলা হচ্ছে বস্তায় বালু ভরার জন্য। আর বাঁধের কাজ বালু-মাটি দিয়েই করতে হবে, তা না হলে ওই পরিমাণ মাটি পাওয়া যাবে না। এতে বাঁধ টিকবে কি না, জানতে চাইলে তিনি ব্যাপারটি এড়িয়ে যান। সুন্দরবনের পাশ থেকে বালু তোলার ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, ‘সেখান থেকে বালু না তুললে তুলব কোথা থেকে?’

প্রকল্পটির পরিচালক হিসেবে আছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের যুগ্ম সচিব সুব্রত পাল চৌধুরী। মুঠোফোনে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাপারটি নিয়ে খুলনা বিভাগীয় কমিশনার আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। আমিও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স আরাধনা এন্টারপ্রাইজের সঙ্গে কথা বলেছি। প্রকল্পের সিডিউলে (দরপত্র) যেভাবে আছে, এখন সেভাবেই বাঁধের কাজ হবে।’

হুমকিতে সুন্দরবন

শাকবাড়িয়া নদীর ওই অংশের এক পারে গাতির ঘেরি গ্রাম ও অন্য পারে সুন্দরবন। ড্রেজার দিয়ে ওই নদীর সুন্দরবনের পাশের দিক থেকে বালু তোলা হচ্ছে। এতে হুমকিতে পড়ছে সুন্দরবন। সুন্দরবন অংশের পাড় ভেঙে যাওয়া ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, সুন্দরবনের পাশ থেকে বালু তোলা সম্পূর্ণ অবৈধ। এতে বনের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। ওই স্থান থেকে বালু তোলার ব্যাপারটি জানা নেই। তবে প্রমাণ পাওয়া গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।