উত্তরা গণভবন ছিল রাজশাহীর দিঘাপতিয়া রাজপরিবারের বাসভবন। ভবনটি মহারাজার প্রাসাদ বা দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি নামেও পরিচিত। প্রায় ৪৩ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এই গণভবনের বর্তমান অবস্থান নাটোর জেলায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সময়ে প্রাসাদটি ‘দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ভবন’ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ১৯৬৭ সালের ২৪ জুলাই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মোনেম খান এ প্রাসাদকে ‘দিঘাপতিয়া গভর্নর হাউস’ হিসেবে ঘোষণা করেন।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ববর্তী গভর্নর হাউস বা দিঘাপতিয়া রাজবাড়িকে ‘উত্তরা গণভবন’ হিসেবে নামকরণ করেন। বর্তমানে দিঘাপতিয়ার প্রাসাদ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রীয় প্রধানের উত্তরাঞ্চলীয় সরকারি বাসভবন বা ‘উত্তরা গণভবন’ হিসেবেই পরিচিত। সরকারের বিভিন্ন সভা এ ভবনে অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ‘গণভবন’ হিসেবে ঘোষিত হওয়ার পর থেকে এটি সরকারি তত্ত্বাবধানে সুরক্ষিত ও সংরক্ষিত হয়ে আসছে। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের সম্পাদনায় বাংলাদেশ শিশু একাডেমি প্রকাশিত বঙ্গবন্ধু কোষ গ্রন্থে এ বিষয়ে যথাযথ তথ্য উল্লিখিত হয়েছে।
১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উত্তরা গণভবনে একটি হৈমন্তীগাছের চারা রোপণ করেন। কিন্তু দীর্ঘদিন অযত্নœআর অবহেলায় গাছটি বিপন্ন হয়ে পড়ে। এই গাছ সম্পর্কে তেমন কোনো খোঁজখবরও জানা ছিল না কারও। মূলত রাজবাড়িটি সংরক্ষিত থাকায় গাছটি চোখের আড়ালেই ছিল দীর্ঘ সময়। বাড়ির সেই অংশে সাধারণ মানুষের তেমন যাতায়াত ছিল না। ফলে প্রায় ৪০ বছর গাছটি জঙ্গলাকীর্ণ ছিল। ২০০২ সালের দিকে প্রথম আলোর নাটোর প্রতিনিধি মুক্তার হোসেনের সহায়তায় যখন এই রাজবাড়ির উদ্ভিদবৈচিত্র্য এবং বিশেষভাবে নির্মিত ‘ইতালিয়ান গার্ডেন’ দেখতে গিয়েছিলাম, তখনো বাড়ির ওই অংশ দুষ্প্রবেশ্য ছিল। বর্তমানে গাছটির বয়স ৪৬ বছর। দীর্ঘদিনের অযত্ন-অবহেলায় এবং ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে গাছটির কাণ্ড ও ডালপালা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সম্প্রতি বিশেষজ্ঞদের একটি দল গাছটি পরিদর্শন করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়েছেন। তারই আলোকে যথাযথ পরিচর্যার মাধ্যমে গাছটি বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। সরেজমিন সেখানে দেখা যায়, আগের তুলনায় গাছটি অনেকটাই সেরে উঠেছে। নিয়মিত ফুলও ফুটছে। ইদানীং অনেক পর্যটক গাছটি দেখতে যাচ্ছেন।
উদ্ভিদবিজ্ঞানের শনাক্তি মতে, উপরিউক্ত উদ্ভিদের সঠিক নাম কুরচি। দেশের প্রচলিত উদ্ভিদ তালিকায় হৈমন্তী নামে পালিত বা প্রাকৃতিক কোনো বৃক্ষের সূত্র খুঁজে পাইনি। কুরচির স্থানীয় অন্যান্য নামের মধ্যে কুটজ বা গিরিমল্লিকা অন্যতম। এ গাছ বৃহত্তর সিলেট, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও দেশের শালবন অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবেই জন্মে। শ্বেত-শুভ্র এই ফুল সুগন্ধের জন্য বিখ্যাত।
হৈমন্তীগাছ লাগানোর পরের বছর ১৯৭৩ সালের ১ জুলাই দেশে দ্বিতীয়বারের মতো বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু সেখানে একটি নারকেলগাছের চারাও রোপণ করেন। ২ জুলাই পূর্বদেশ পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বৃক্ষরোপণ পক্ষ উদ্বোধন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ সকালে উত্তরা গণভবন প্রাঙ্গণে একটি নারকেলের চারা রোপণ করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সেক্রেটারি জনাব তোফায়েল আহমদ এবং বাংলাদেশ রেডক্রসের চেয়ারম্যান কাজী গোলাম মোস্তফাও একটি করে চারা লাগান। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু সেদিন বিভাগীয় ফরেস্ট অফিসারকে উত্তরা গণভবনের লেকের পাড়ে নারকেলগাছের চারা লাগানোর নির্দেশ দেন।’