২০৪৫ সালের মধ্যে কক্সবাজারের সেন্ট মার্টিন দ্বীপ প্রবালশূন্য হওয়ার আশঙ্কা।
দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে দিন দিন প্রবাল কমছে। কমছে দ্বীপের বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকাও। বিপরীতে বাড়ছে পর্যটক। তাঁদের আবাসনের জন্য নতুন হোটেল ও অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে।
দ্বীপে স্থায়ীভাবে বসবাস করা জনসংখ্যাও বাড়তি, যা চাপ ফেলছে দ্বীপের জীববৈচিত্র্যের ওপর। সব মিলিয়ে সেন্ট মার্টিনের অনন্য প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষক ও এক শিক্ষার্থীর এক গবেষণায় উঠে এসেছে সেন্ট মার্টিনের দুর্দশার এ চিত্র। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক, চার দশক আগে দ্বীপটির যতটুকু ভূমি প্রবালে আচ্ছাদিত ছিল, তার তিন ভাগের এক ভাগও এখন অবশিষ্ট নেই। কোরাল বা প্রবাল—এক ধরনের অমেরুদণ্ডী সামুদ্রিক প্রাণী। বহিরাবরণ শক্ত হওয়ার কারণে অনেক সময় একে ভুল করে পাথর ভাবা হয়। পলিপ নামের অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণীর সমন্বয়ে তৈরি হয় একটি প্রবাল।
গবেষণা নিবন্ধটির অন্যতম লেখক মো. ইউসুফ গাজী প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে ২০৪৫ সালের মধ্যে সেন্ট মার্টিন দ্বীপটি পুরোপুরি প্রবালশূন্য হয়ে যাবে। আমরা তখন হয়তো দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন কথাটিও বলতে পারব না। প্রবাল শুধু জাদুঘরেই পাওয়া যাবে।’
সেন্ট মার্টিন নিয়ে গবেষণাটি ৯ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক ওশান সায়েন্স জার্নাল–এ প্রকাশিত হয়। ‘জিওস্পাশিয়াল প্রযুক্তি ব্যবহার করে বঙ্গোপসাগরে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের প্রবাল ধ্বংস চিহ্নিত করা’ শীর্ষক গবেষণা নিবন্ধটির লেখক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. কাউসার আহাম্মদ, ভূতত্ত্ব বিভাগের প্রভাষক মো. ইউসুফ গাজী ও সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী তাহরিমা জান্নাত।
সেন্ট মার্টিন কক্সবাজার জেলা শহর থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে সাগরবক্ষে বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ। প্রশাসনিকভাবে দ্বীপটি কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার একটি ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নে গ্রাম আছে ৯টি। সরকারি তথ্যে দ্বীপের আয়তন ১৩ বর্গকিলোমিটার উল্লেখ রয়েছে। তবে গবেষণায় বলা হয়েছে ৮ বর্গকিলোমিটার। সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নূর আহমেদ গতকাল বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, দ্বীপের চারদিকে ভাঙন দেখা দিয়েছে। কয়েক বছর ধরে ভাঙনের কারণে দ্বীপের আয়তনও কমেছে। এই দ্বীপকে রক্ষায় বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের ভিত্তিতে দ্রুত বাঁধ নির্মাণ করা দরকার। তিনি বলেন, এই দ্বীপের প্রবাল, শৈবাল রক্ষায় সরকারি কোনো উদ্যোগ নেই। তবে দুই বছর ধরে স্থানীয়ভাবে প্রবাল উত্তোলন ও পাচার বন্ধে তাঁরা কাজ করছেন। এ ছাড়া পর্যটকেরা যে পরিমাণ বর্জ্য ফেলে যান, তা অপসারণে সরকারি কোনো বারাদ্দ ও ব্যবস্থা নেই। এসব বর্জ্য সাগরে গিয়ে পড়ে।
প্রতিবছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকে শুরু করে মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত এই দ্বীপে বেড়াতে যান পর্যটকেরা। গবেষণায় বলা হয়, ১৯৯৬-১৯৯৭ সময়ে সেন্ট মার্টিনে পর্যটক যেতেন বছরে ২০০ জনের কম। এখন যান দেড় লাখের বেশি। একই সময়কালে (’৯৬–৯৭ সাল) সেখানে জনসংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৭০০ জন, যা ২০১৬ সালে ৮ হাজার ছাড়িয়েছে। ২০১২ সালে সেন্ট মার্টিনে ১৭টি হোটেল ছিল। ২০১৮ সালে তা ৪৮টিতে দাঁড়ায়। তবে স্থানীয় হিসাব অনুযায়ী, এখন সেন্ট মার্টিনে হোটেল, মোটেল ও কটেজের সংখ্যা ১২৪টি। জনসংখ্যা প্রায় ৯ হাজার ৭৬০ জন। তবে পর্যটন মৌসুমে হোটেল, মোটেল ও কটেজ পরিচালনার জন্য বাড়তি প্রায় আড়াই হাজার লোক কয়েক মাস সেন্ট মার্টিনে অবস্থান করে।
সেন্ট মার্টিনের তুলনামূলক চিত্র বুঝতে গবেষকেরা স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবি বিশ্লেষণ করেন। ছবিগুলো ১৯৮০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়ের। এ ছাড়া মাঠপর্যায়ে গবেষণা করা হয়। দেখা যায়, ৩৮ বছরে দ্বীপটিতে প্রবাল আচ্ছাদন ১ দশমিক ৩২ বর্গকিলোমিটার থেকে কমে শূন্য দশমিক ৩৯ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। প্রবাল প্রজাতি ১৪১টি থেকে কমে ৪০টিতে নেমেছে। বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা সাড়ে ৪ বর্গকিলোমিটার থেকে কমে নেমেছে ৩ বর্গকিলোমিটারে।
গবেষণায় সেন্ট মার্টিনের পরিবেশদূষণ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির জন্য কয়েকটি মানবসৃষ্ট কারণ চিহ্নিত করা হয়। যার মধ্যে অন্যতম অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন, আবাসিক হোটেলগুলোর দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পর্যটকদের ব্যবহৃত সামগ্রী সমুদ্রের পানিতে নিক্ষেপ, পাথর উত্তোলন, প্রবাল উত্তোলন ও উপকূলীয় এলাকায় মাছ ধরার জালের যত্রতত্র ব্যবহার। গবেষকেরা আরও বলেছেন, সেন্ট মার্টিনে নতুন জন্মানো প্রবালগুলো জেলেদের জালের টানে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জেলেরা দ্বীপের চারপাশে তীর থেকে প্রায় ৫০০ থেকে ১ হাজার মিটার উপকূলবর্তী এলাকায় জাল ফেলে মাছ ধরেন, যেখানে সবচেয়ে বেশি প্রবালের জন্ম হয়।
গবেষকেরা বলছেন, সামুদ্রিক দ্বীপে প্রবাল জন্মানোর নিয়ামকগুলো হলো জলরাশির তাপমাত্রা, পানিতে লবণের পরিমাণ, বালুকণার পরিমাণ, পানির অম্লতা, ঢেউয়ের তীব্রতা, দ্রবীভূত অক্সিজেন ইত্যাদি। তবে এর মধ্যে প্রধান নিয়ামক হচ্ছে অক্সিজেন। ধীরে ধীরে এই নিয়ামকগুলোর প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এর জন্য কিছু প্রাকৃতিক কারণও রয়েছে। দ্বীপের চারপাশের সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন ও সামুদ্রিক জলের রাসায়নিক পরিবর্তন যার মধ্যে অন্যতম। সেন্ট মার্টিনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর কী করছে, জানতে চাইলে সংস্থাটির মহাপরিচালক এ কে এম রফিক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পর্যটকদের নিয়ন্ত্রণে আমরা আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণাটির আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) একাধিক গবেষণায় একই ধরনের চিত্র উঠে আসে। ওই সব গবেষণায় দ্বীপটিকে রক্ষায় জরুরি ভিত্তিতে সেখানে পর্যটকদের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ করা হয়। কিন্তু কাজ খুব একটা হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক হুমায়ূন আখতার প্রথম আলোকে বলেন, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ জীববৈচিত্র্যের দিক দিয়ে পৃথিবীর মধ্যেই অনন্য। সেখানে স্বচ্ছ পানির কারণে প্রবাল জন্ম নেয়। নির্বিচার পর্যটক যেতে দিয়ে পানি দূষিত করে ফেলা হয়েছে। সেন্ট মার্টিনকে জাতীয় সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করে এর সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া দরকার।