প্রতিষ্ঠানটির দাবি করা জায়গায় বিপুল পরিমাণ পাথর সংরক্ষিত হয়েছে। এই পাথর উত্তোলন করা হলে ইসিএ কার্যকর ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সিলেটের জাফলংকে প্রতিবেশ-সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় ২০১৫ সালে। সেই থেকে বালু ও পাথর কোয়ারি হিসেবে ইজারা বন্দোবস্ত কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় ইসিএভুক্ত এলাকায় ভূমি বন্দোবস্ত নেওয়া আছে—এই দাবিতে সাইনবোর্ড সাঁটিয়েছে একটি প্রতিষ্ঠান।
হাইকোর্টের রিট আদেশ নম্বরসংবলিত সাইনবোর্ডে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘খনিজসম্পদ উত্তোলনের কাজ চলিতেছে’। জাফলংয়ের শূন্যরেখার কাছের একটি টিলার পাদদেশে গত শনিবার এ সাইনবোর্ড সাঁটানো দেখা যায়।
সাইনবোর্ডে খনিজ সম্পদ উত্তোলনের কাজ চলার কথা উল্লেখ থাকলেও কোন প্রতিষ্ঠান এতে জড়িত, এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। অবশ্য ওই রিট নম্বর দিয়ে সম্প্রতি মেসার্স জালালাবাদ লাইম ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড ট্রেডিং অ্যাসোসিয়েশন জাফলংয়ে প্রায় ৪৮ বছর আগের বন্দোবস্ত পাওয়া ভূমির দাবি নিয়ে উপজেলা প্রশাসনে চিঠি দেয়। চিঠি পাঠিয়ে প্রতিষ্ঠানটি দাবি করা ভূমি থেকে পাথর উত্তোলনের প্রস্তুতি শুরু করে।
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নাজমুস সাকিব বলেন, ইসিএভুক্ত এলাকায় বালু-পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ। তাই সাইনবোর্ড সাঁটানোর পর বিষয়টি খনিজ সম্পদ ব্যুরো ও ইসিএ কার্যকরে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতিকে (বেলা) জানানো হয়েছে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, পাথর উত্তোলনে যন্ত্রনির্ভরতা জাফলংকে সংকটাপন্ন করে তোলে। ২০১২ সালে বেলার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় জাফলংকে ইসি ঘোষণার নির্দেশনা দেওয়া হয়। ২০১৫ সালে প্রজ্ঞাপন জারি হয়। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী পাথর উত্তোলন কার্যক্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে ইসিএ ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠনের মাধ্যমে পরিবেশ ও প্রতিবেশ উন্নয়নমূলক কার্যক্রম চালাতে বলা হয়েছে।
উপজেলা প্রশাসন জানায়, ইসিএর প্রজ্ঞাপন জারির এক বছরের মাথায় ২০১৬ সালে জাফলংকে ‘ভূতাত্ত্বিক ঐতিহ্য’ ঘোষণা করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এতে জাফলংয়ের ২২ দশমিক ৫৯ একর জায়গাকে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়। জালালাবাদ লাইম ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড ট্রেডিং অ্যাসোসিয়েশনের ‘মাইনিং লিজ’ ভূমি পড়েছে জাফলংয়ে ইসিএ ও ভূতাত্ত্বিক ঐতিহ্যঘোষিত সংরক্ষিত এলাকায়।
গত ১৭ আগস্ট অ্যাসোসিয়েশনটি চিঠির মাধ্যমে উপজেলা প্রশাসনকে ভূমির দখল বুঝিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করে। চিঠিতে বলা হয়, চৈলাখেল মৌজার ৬ দশমিক ৫৮ একর ভূমি পাথর উত্তোলনের জন্য ১৯৭২ সালের ১১ অক্টোবর অধিগ্রহণ করা হয়। পরে ৭৮ দশমিক ২৭ একর ভূমি ‘মাইনিং লিজ’ নেওয়া হয়। ১৯৯১ সালের ৪ ডিসেম্বর ও ১২ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসনের ভূমিসংশ্লিষ্ট দপ্তর কোনো ধরনের বিজ্ঞপ্তি না দিয়েই বন্দোবস্ত বাতিল করে। এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হলে সম্প্রতি ভূমির ভোগদখল বজায় রাখার আদেশ পান তাঁরা।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, প্রতিষ্ঠানটির দাবি করা জায়গায় ইসিএ ঘোষণার পর থেকে বিপুল পরিমাণ পাথর সংরক্ষিত হয়েছে। গত পাহাড়ি ঢলেও সাদা পাথরের একটি স্তূপ জমা হয়েছে জাফলং শূন্যরেখার আশপাশে। এই পাথর উত্তোলন করা হলে জাফলংয়ে পুরো ইসিএ কার্যকর ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
জালালাবাদ লাইম ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড ট্রেডিং অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান কার্যালয় সুনামগঞ্জের ছাতকে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফছার উদ্দিন বলেন, ‘দেরিতে হলেও উচ্চ আদালতের আদেশ পেয়ে আমরা দখল দেখাচ্ছি।’
৪৮ বছর আগের দাবি নিয়ে এখন সক্রিয় হওয়ার পেছনে কোনো দুরভিসন্ধি আছে বলে মনে করছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। বেলা সিলেট অঞ্চলের সমন্বয়ক শাহ শাহেদা আখতার বলেন, এত দিন কোথায় ছিল প্রতিষ্ঠানটি? এটি আসলে জাফলংয়ে বিগত দিনে জমা হওয়া পাথর সাবাড় করার একটি অপকৌশল।
বাংলাদেশ খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর (বিএমডি) সহকারী পরিচালক (ভূপদার্থ) মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘জাফলং ইসিএভুক্ত। এ জন্য ইসিএ নির্দেশনার বাইরে কোনো কার্যক্রম নেই।’