কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগা ইউনিয়নের প্রায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দী। ব্রহ্মপুত্র নদের মধ্যে অনেকগুলো চর নিয়ে গড়ে ওঠা ওই জনপদে যেতে সদর থেকে নৌকায় প্রায় তিন ঘণ্টা লাগে। এ পর্যন্ত সেখানে তিনবার ত্রাণ গেছে। যা গেছে, তা-ও বেশির ভাগ মানুষ পায়নি।
সাহেবের আলগা ইউনিয়নের খালেদা বেগম জানান, সদরসহ অনেক এলাকায় ত্রাণ দিচ্ছে শুনেছেন কিন্তু তিনি এখনো কোনো ত্রাণ পাননি। বাড়ি ছেড়ে যেতে পারছেন না, তাই ত্রাণও আনতে পারছেন না। এলাকার এর-ওর কাছ থেকে খাবার এনে চলছেন বলে জানান তিনি।
সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত ১৮টি জেলার প্রায় ২২ লাখ মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় আছে। তাদের মধ্যে এ পর্যন্ত আটজন মারাও গেছে। বন্যার্তদের বড় অংশ দুর্গম চর ও নিম্নাঞ্চলগুলোতে বাড়ির ছাদ, আশপাশের সড়ক, বাঁধ ও উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে রান্নার ব্যবস্থা খুব একটা নেই। অনেক জেলায় প্রতিদিনই বৃষ্টি হচ্ছে। ফলে শুকনা খাবার আধপেটা খেয়ে তাদের দিন চলছে বলে প্রথম আলোর রংপুর, তারাগঞ্জ ও কুড়িগ্রাম প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। তাঁরা জানিয়েছেন, উপজেলা ও ইউনিয়ন সদরগুলোতে ত্রাণ ঠিকঠাকমতো পৌঁছালেও সমস্যা হচ্ছে দুর্গম চরগুলোতে। প্রশাসনিক এলাকা থেকে দূরে হওয়ায় এসব এলাকায় ত্রাণ যাচ্ছে না।
এর কারণ হিসেবে স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, করোনার সময় দেওয়া ত্রাণ বা কাজের বিনিময়ে খাদ্যের মতো ত্রাণগুলো স্থানীয়দের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আলাদা বরাদ্দ থাকে। কিন্তু বন্যার্তদের ত্রাণ পৌঁছানো অন্য কর্মসূচিগুলোর তুলনায় ব্যয়বহুল হলেও এর জন্য আলাদা কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। ফলে অনেক দুর্গম এলাকায় নিয়মিত ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে না।
তবে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা করোনার ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার জন্য দুই কোটি টাকার ওপরে বরাদ্দ দিয়েছিলাম। তবে বন্যার জন্য আগাম কোনো বরাদ্দ দেওয়া না হলেও দুর্গম এলাকায় ত্রাণ পৌঁছাতে যে খরচ হবে, তা বিল করলে আমরা দিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেব।’
>বন্যার ত্রাণের পরিবহন খরচ দেওয়া হয় না
তাই দুর্গম এলাকায় ত্রাণ না যাওয়ায় শুকনা খাবার খেয়ে আছে বন্যার্ত মানুষ
কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার ত্রাণ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা ১২ জন কর্মকর্তার সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। এর মধ্যে দুজন জেলা প্রশাসকও রয়েছেন। এসব কর্মকর্তা জানান, অনেক বছর ধরেই বন্যার ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে পরিবহন খরচ স্থানীয়ভাবে জোগাড় করার অলিখিত নিয়মের প্রচলন রয়েছে। যেমন ত্রাণ হিসেবে চাল বিতরণের ক্ষেত্রে চালের বস্তা বিক্রি করে পরিবহন খরচের একাংশ জোগাড় করা হয়। ১ মণ চালের সঙ্গে ২৫টি বস্তা থাকে, ত্রাণ বিতরণ শেষে সেগুলো একেকটি ২০ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি করে ওই খরচ জোগানো হয়।
কাবিখা বা অন্যান্য কর্মসূচির ক্ষেত্রে প্রতি টন খাদ্য পরিবহনের জন্য ২৩০ টাকা বরাদ্দ থাকে। কিন্তু কুড়িগ্রাম, জামালপুর, রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের অনেক এলাকা আছে, যেখানে যেতে সদর থেকে ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার পর্যন্ত সড়ক ও নৌপথ পাড়ি দিতে হয়। এসব এলাকায় এক টন ত্রাণ পৌঁছাতে ট্রলারে যেতে দু-তিন হাজার টাকা খরচ লেগে যায়। তখন ওই খরচ জোগাতে ত্রাণের একাংশ বিক্রি করে দেওয়া হয়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাধারণত আমরা জেলা ত্রাণভান্ডার থেকে বরাদ্দ দিই। স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা তা তুলে বিতরণ করেন। তবে যারা দূরবর্তী ও দুর্গম এলাকায় পানিবন্দী অবস্থায় আছে, তাদের কাছে ত্রাণ পৌঁছানো একটু কঠিন হলেও আমরা তা করছি।’
এদিকে ব্রহ্মপুত্র নদের উজানে বৃষ্টি কমে আসায় সেখানে পানি বৃদ্ধি কমে এসেছে বলে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে। ব্রহ্মপুত্র থেকে পানি যমুনা দিয়ে নামতে শুরু করায় ওই নদীতীরবর্তী টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, বগুড়াসহ আটটি জেলার বন্যার পানি বাড়ছে। আগামী দু-এক দিন তা আরও বাড়তে পারে। তবে ২১ জুলাই থেকে উজানে বৃষ্টি বেড়ে ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা অববাহিকায় পানি আবারও বেড়ে মাসের শেষ পর্যন্ত সেখানে বন্যা থাকতে পারে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূইয়া প্রথম আলোকে বলেন, বন্যার পানি ব্রহ্মপুত্র থেকে নামতে শুরু করলেও যমুনা ও পদ্মায় পানি দু-এক দিন বাড়বে। তবে আগামী তিন-চার দিনের মধ্যে ব্রহ্মপুত্রে আবারও বন্যা বেড়ে এক সপ্তাহ পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বয়ে যেতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে আজ শুক্রবারের জন্য দেওয়া পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, রংপুর, রাজশাহী, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও খুলনার বেশির ভাগ এলাকায় বৃষ্টি হতে পারে। রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য এলাকার কিছু কিছু স্থানেও বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দেশের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে পঞ্চগড়ে, ৪৯ মিলিমিটার।