পাখি কমছে বিশ্বজুড়ে

কাপ্তাই হ্রদের পানি অনেকটা কমে গেছে। তাই মাছ, শামুক ও ঝিনুক খেতে তীরে বসে এক ঝাঁক শামুকখোল পাখির অপেক্ষা। শিকার ধরা পড়লেই উড়াল দেয় এরা। গতকাল রাঙামাটি সদরের দীঘলিবাগ এলাকায়
ছবি: সুপ্রিয় চাকমা

বিশ্বে কত পাখি আছে, তার সংখ্যা বলা মুশকিল। তবে পাখি আছে ১১ হাজার প্রজাতির। এর মধ্যে ৪৮ শতাংশ বা ৫ হাজার ২৪৫ প্রজাতির পাখির সংখ্যা কমছে। একটি বৈশ্বিক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য দেওয়া হয়েছে।

‘স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ডস বার্ডস’ বা ‘বিশ্বের পাখি পরিস্থিতি’ শিরোনামের এ প্রতিবেদন ৫ মে প্রকাশিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার আটটি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা এ গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। গবেষকেরা বলছেন, প্রাকৃতিক আবাসস্থল কমে যাওয়ায় বা আবাসস্থল বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ায় পাখি কমে আসছে। পাখি কমে আসার নতুন কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে দেখা হচ্ছে।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী ৪ হাজার ২৯৫ বা ২৯ শতাংশ প্রজাতির পাখির সংখ্যা অপরিবর্তিত দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ তাদের সংখ্যা বাড়ছে না বা কমছে না। অন্যদিকে ৬৭৬ প্রজাতির বা ৬ শতাংশ প্রজাতির পাখির সংখ্যা বাড়ছে। বাকি প্রজাতির পাখির সংখ্যা বাড়ছে নাকি কমছে, তা গবেষকেরা অনুসন্ধান করেও বুঝতে পারেননি।

গবেষকেরা বলছেন, পাখির সংখ্যা কমে আসার যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তা সামঞ্জস্যহীন। অর্থাৎ বিশ্বের সব এলাকার তথ্য সমানভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। সবচেয়ে ভালো পরিসংখ্যান তাঁরা পেয়েছেন উত্তর আমেরিকা থেকে।

বাংলাদেশ ছোট দেশ, জনসংখ্যা অনেক বেশি। পাখির বাসা বাঁধা, চরে বেড়ানোর মতো জায়গা কম। একমাত্র সুন্দরবন ছাড়া পাখির নির্বিঘ্ন আবাসস্থল নেই।
ইনাম আল হক, পাখি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ বার্ডস ক্লাবের সভাপতি

উত্তর আমেরিকার ৫২৯টি প্রজাতির মধ্যে ৩০৩টি প্রজাতির বা ৫৭ শতাংশ প্রজাতির পাখি কমে আসার প্রবণতা দেখা গেছে। ১৯৭০ সালের তুলনায় উত্তর আমেরিকায় পাখির সংখ্যা ৩০০ কোটি কমেছে। তৃণভূমির সঙ্গে সম্পর্কিত প্রজাতিগুলোর পরিণতি সবচেয়ে খারাপ হয়েছে। সবচেয়ে চোখে পড়ে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমে আসা। ৪১৯ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি উত্তর আমেরিকায় কমে এসেছে। গবেষকেরা একই প্রবণতা লক্ষ করেছেন ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ায়।

ওই প্রতিবেদনে পৃথকভাবে বাংলাদেশের পাখি পরিস্থিতির উল্লেখ নেই। তবে প্রতিবেশী দেশ ভারতের পরিসংখ্যান আছে। বলা হচ্ছে, ভারতে ১৪৬ প্রজাতির পাখি কমছে। ৬ প্রজাতির পাখি বাড়ছে না বা কমছে না।

বাংলাদেশে ৭১৫ প্রজাতির পাখি আছে। এর মধ্যে ৫০ প্রজাতির পাখি ঝুঁকির মধ্যে আছে বলে প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর জোট আইইউসিএনের তালিকায় পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশের পাখির ব্যাপারে জানতে চাইলে পাখি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ বার্ডস ক্লাবের সভাপতি ইনাম আল হক প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ ছোট দেশ, জনসংখ্যা অনেক বেশি। পাখির বাসা বাঁধা, চরে বেড়ানোর মতো জায়গা কম। একমাত্র সুন্দরবন ছাড়া পাখির নির্বিঘ্ন আবাসস্থল নেই।

ডানা মেলে সবখানে

বৈশ্বিকভাবে পাখির অবস্থান প্রায় সর্বব্যাপী। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে পাখির প্রজাতির প্রাচুর্য বেশি। সাধারণত বিশ্বের প্রায় সব স্থানে পাখি দেখা যায়। মৌসুমভেদে দুই মেরুতেই পাখি থাকে। মহাসাগরের প্রান্তিকতম অববাহিকায় পাখি আছে। সবচেয়ে অনুর্বর মরুভূমিতে ও বিশ্বের উচ্চতম পর্বতেও পাখি চোখে পড়ে। বিচ্ছুরণ বা সব দিকে ছড়িয়ে পড়ার অনন্য ক্ষমতা প্রাণিকুলে কম দেখা যায়।

কেন পাখি বিপন্ন

গবেষকেরা বিশ্বব্যাপী পাখি কমে যাওয়ার বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন। অব্যাহতভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও মাথাপিছু জমি ব্যবহারের কারণে পাখির প্রাথমিক আবাসভূমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তার ফল হিসেবে পাখির বৈচিত্র্য কমে যাচ্ছে। শুধু জমির ব্যবহারে পরিবর্তন আসায় বিশ্বে ১৬৫ প্রজাতির পাখি চরম হুমকির মুখে।

ভূমি ব্যবহারে পরিবর্তন আসায় পাখির আবাসভূমি অনেক ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভাগ হয়ে পড়েছে। এতে আবাসভূমির মান কমে গেছে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে পাখির প্রজাতি বিলুপ্তির অন্যতম কারণ আবাসভূমি টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া। বেছে বেছে গাছ কাটা, দাবানল, গৃহপালিত পশুর অতিমাত্রায় চরানো—এসবও পাখির জন্য হুমকি। খাদ্যের জন্য, খেলার জন্য, ব্যবসার জন্য পাখি শিকার হয় প্রায় বিশ্বজুড়ে। সমুদ্রে যাঁরা মাছ ধরেন, তাঁরা অতিরিক্ত শিকার হিসেবে পাখি বেছে নেন।

গবেষণায় ২৩০টি দেশে ও প্রশাসনিক অঞ্চলে ৯৭১টি ভিনদেশি পাখির প্রজাতি দেখা গেছে। কিছু ক্ষেত্রে ভিনদেশি এসব প্রজাতি প্রাকৃতিকভাবে চলে গেছে, কিছু ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃতভাবে এসব প্রজাতি আনা হয়েছে। ভিনদেশি কিছু প্রজাতি স্থানীয় প্রজাতির জন্য হুমকি তৈরি করে। আবার পাখির রোগও পাখির জন্য হুমকি।

অবকাঠামো নির্মাণ, খনিজ তেল উত্তোলন, দূষণ, কৃষি রাসায়নিকও পাখির জন্য নিয়মিত হুমকি হয়ে আছে। এর সঙ্গে নতুন হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে। গবেষকেরা বলছেন, বৈশ্বিক টেলিসংযোগ ব্যবসাও পাখির জীবনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গবেষকেরা বলছেন, বৈশ্বিকভাবে ও অনেক অঞ্চলে স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির বিপন্নতার কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। পরিমাণে কম হলেও পাখি সংরক্ষণের উদ্যোগও আছে। এখন দরকার স্থানীয়, অঞ্চলিক ও বৈশ্বিক উদ্যোগ বাড়ানো।