নদীভাঙন বাড়তে পারে, বড় বন্যার আশঙ্কা কম

দেশের ১৩টি জেলার ২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা এ বছর ভাঙনের মুখে পড়তে পারে

এ বছর বর্ষায় অস্বাভাবিক বৃষ্টি বা উজান থেকে বড় ঢল আসার আশঙ্কা কম। তবে নদীভাঙন তীব্র হতে পারে। ছবিটি ফরিদপুরের

এ বছর বর্ষায় অস্বাভাবিক বৃষ্টি বা উজান থেকে বড় ঢল আসার আশঙ্কা কম। একইভাবে স্বস্তির খবর হচ্ছে, এবার দেশে দীর্ঘস্থায়ী বন্যার আশঙ্কাও তেমন নেই। তবে নদীভাঙন তীব্র হতে পারে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) পূর্বাভাস অনুযায়ী, দেশের ১৩টি জেলার ২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা এ বছর ভাঙনের মুখে পড়তে পারে।

সরকারের পানি উন্নয়ন বোর্ডের ট্রাস্টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিইজিআইএসের পূর্বাভাস অনুযায়ী, তীব্র ভাঙনের মুখে পড়তে পারে কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, রাজশাহী, ফরিদপুর ও মাদারীপুর। তবে নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিইজিআইএসের পূর্বাভাসের তালিকায় না থাকলেও শরীয়তপুর, চাঁদপুর ও মুন্সিগঞ্জ জেলায় গত দুই বছর তীব্র ভাঙন দেখা যায়। এই তিন জেলায় এবারও নদী–তীবরর্তী এলাকায় ভাঙন দেখা দিতে পারে।

সিইজিআইএস গত বছর থেকে দেশের ১৩টি জেলায় ২৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা ভাঙনের মুখে পড়বে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে ভেঙেছে ৩৮ বর্গকিলোমিটার। এটি সিইজিআইএসের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

গবেষকেরা বলছেন, ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে দেশে নদীভাঙন কমছিল। এমনকি চাঁদপুর, শরীয়তপুর, সিরাজগঞ্জ থেকে বগুড়ার মতো তীব্র ভাঙনপ্রবণ এলাকায়ও ভাঙন অনেকটা কমে যায়। কিন্তু ২০২০ সালে এসে পরিস্থিতি আবার পাল্টাতে থাকে। ওই তিন বছর ভাঙনকবলিত এলাকায় নতুন বাঁধ নির্মাণ, মেরামতসহ বিভিন্ন ধরনে অবকাঠামো নির্মাণ করেছিল সরকার। এর ফলে ভাঙন কমে আসে। ওই তিন বছর দেশে তীব্র বন্যা হয়নি।

সিইজিআইএসের সমীক্ষা অনুযায়ী, ১৯৭৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশের ১ হাজার ৭০০ বর্গকিলোমিটারের বেশি এলাকা নদীতে বিলীন হয়েছে। এতে প্রায় ১৭ লাখ ১৫ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।

সিইজিআইএসের উপদেষ্টা ও ভাঙন পূর্বাভাস গবেষণা দলের প্রধান মমিনুল হক সরকার প্রথম আলোকে বলেন, গত দুই বছর দেশে বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে আসা পানির পরিমাণ বেশি ছিল। যে কারণে পদ্মার দুই পাড়ের অনেক সুরক্ষিত এলাকাও ভাঙনের হুমকিতে পড়েছে। স্বাভাবিক বন্যা হলেও সেখানে ভাঙন হতে পারে। ভাঙন মোকাবিলায় এখন থেকেই বাঁধ সংস্কারের কাজে গতি আনতে হবে। বিষয়টিকে অত্যন্ত জরুরি কাজ হিসেবে বিবেচনায় নিতে হবে।

সিইজিআইএসের পূর্বাভাস অনুযায়ী, এবারের বর্ষা মৌসুমে দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের ১৩ জেলায় পদ্মা, গঙ্গা ও যমুনা নদীর তীরবর্তী এলাকাই মূলত ভাঙনের মুখে পড়বে। এতে পৌনে ৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ, ৬ কিলোমিটার সড়ক ও গ্রামীণ সড়ক বিলীন হয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া ভাঙনে দোকানপাট, বসতবাড়ি, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, হাটবাজার এমনকি হাসপাতালও বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

নদী ও দুর্যোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পদ্মাতীরবর্তী শরীয়তপুরের নড়িয়া, মাদারীপুরের শিবচর ও চাঁদপুর সদরে ভাঙন মোকাবিলায় গত এক বছরে বেশ কয়েকটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ফলে সেখানে এবার ভাঙন কম হতে পারে। পদ্মাপারের তুলনায় ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তাপারে ভাঙন মোকাবিলায় বড় কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যে কারণে সেখানে এবার ভাঙন বাড়তে পারে।

পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম প্রথম আলোকে বলেন, শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের যে এলাকায় বেশি ভাঙন সেখানে জরুরি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে ভাঙন ঠেকানো হয়েছে। অন্য এলাকার ভাঙন ঠেকাতেও নতুন কয়েকটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। সারা দেশেই ভাঙন মোকাবিলায় সরকার কাজ করছে।

এদিকে সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, গত বছর জুন মাসের শেষের দিকে দেশে বন্যা শুরু হলেও এবার সেই আশঙ্কা নেই। আগামী জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে দেশের উজানে নেপালের গঙ্গা অববাহিকায় বেশি বৃষ্টি হতে পারে। ফলে সেখান থেকে আসা পানি পদ্মা ও মেঘনা অববাহিকায় বন্যা সৃষ্টি করতে পারে।

আর আগস্টের শুরুতে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে বৃষ্টি হতে পারে। এতে দেশের উত্তরাঞ্চলে বন্যা হতে পারে। তিস্তা অববাহিকায়ও জুলাইয়ের শেষে ও আগস্টের শুরুতে বন্যা হতে পারে। তবে বন্যা হলেও তা খুব বেশি তীব্র হওয়ার আশঙ্কা নেই বলে মনে করছেন বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা।

এ ব্যাপারে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত দেশের ভেতরে ও উজানে বৃষ্টিপাত দেখে মনে হচ্ছে চলতি মাসে বন্যার আশঙ্কা কম। জুলাইয়ের মাঝামাঝি ও আগস্টে স্বাভাবিক বন্যা হতে পারে।

এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে বলা হয়েছে, বঙ্গোপসাগরে আজ শুক্রবার একটি লঘুচাপ তৈরি হতে যাচ্ছে। এর ফলে আজ ও আগামীকাল বৃষ্টি বাড়তে পারে। সামগ্রিকভাবে এ বছর বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের চেয়ে কম হতে পারে। তবে উজানে বেশি বৃষ্টিপাত হওয়ায় গঙ্গার পানি বেড়ে পদ্মা ও যমুনায় পানি বাড়তে পারে।