পদ্মা নদীর আশারিয়াদহ ঘাটের ঠিক পুব দিকে খানিকটা গেলেই ভারতের সীমানা। রাজশাহীর গোদাগাড়ী ঘাট থেকে নৌকা নিয়ে যাওয়া যায় আশারিয়াদহে। প্রতি শীতেই ওই এলাকায় পাখি দেখতে যাই। প্রথমবার গিয়েছিলাম ২০১১ সালের ২৭ জানুয়ারি। পরিযায়ী পাখির ভালো আনাগোনা থাকে সেখানে। সৈকতপাখি, পরিযায়ী হাঁসসহ বেশ কয়েক জাতের দেশি জলচর পাখির দেখা পেলাম সে যাত্রায়। তবে সবকিছু ছাপিয়ে একটি পাখিকে একেবারেই আলাদা করে পেলাম। খুব কাছাকাছি গিয়ে নৌকা থামিয়ে ছবি ওঠালাম। দারুণ এক অনুভূতি। ধারণা করলাম, পাখিটি ধলাগলা মানিকজোড়। ডাঙায় এসে ফিল বুকে মিলিয়ে নিশ্চিত হলাম।
ধলাগলা মানিকজোড় এভাবে পেয়ে যাব, তা কখনো ভাবিনি। পাখিটির দেখা পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার ছিল। উনিশ শতকের শেষভাগে গবেষক ক্রিপস ও হিউমে মাত্র দুটি পাখি দেখার তথ্য দেন এ দেশ থেকে। এর প্রায় ১০০ বছর পর ৯ অক্টোবর ২০০৯ সালে সুন্দরবনের কটকা থেকে পাখি-গবেষক সায়েম ইউ চৌধুরী পাখিটির উড়ন্ত অবস্থার একটি ছবি তোলেন। তার ঠিক ১৬ মাস পর পদ্মায় পাখিটির দেখা পাই। এর পর থেকে পদ্মা ও যমুনা নদীর বিভিন্ন অঞ্চলে পাখিটি নিয়মিতই দেখা যাচ্ছে।
ধলাগলা মানিকজোড়কে একসময় ইতস্তত ভ্রমণকারী পাখি ভাবা হলেও এখন প্রজাতিটি নিয়মিত শীতের পরিযায়ী। রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে পদ্মা ও মহানন্দায় শীতে ৩০-৪০টি পাখির দেখা মেলে। তবে সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, ২০১৭ সালে এই পাখির একটি বাসার দেখা মেলে রাজশাহীর রাজাবাড়ী এলাকায়। বাসাটি ছিল একটি মুঠোফোনের টাওয়ারে। সে বছর ওই বাসা থেকে দুটি বাচ্চা পাওয়া যায়। এর পরের দুই বছরও বাসাটিতে নিয়মিত বাচ্চা ফুটিয়েছে পাখিযুগল। তিন বছরে মোট সাতটি বাচ্চা পাওয়া যায়। পাখিদেখিয়ে মুহাম্মদ তারিক হাসান ও প্রাসাদ ঘিমিরে এই পাখির প্রজনন নিয়ে একটি নোট প্রকাশ করেন। তাঁরা ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দ্বিতীয় পাখির বাসার সন্ধান পান। এ বাসাও ছিল একটি মুঠোফোন টাওয়ারে। জায়গাটি ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের জয়দেবপুরের কাছাকাছি। বাসাটিতে পাখি ডিম পাড়লেও কোনো বাচ্চা পাওয়া যায়নি। ২০১৯ সালে পাখিরা বাসাটি ছেড়ে যায়।
ধলাগলা মানিকজোড় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে বেশ ভালো সংখ্যায় টিকে আছে। ভারতে এদের সংখ্যা এখন বেশ ভালো। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও মালদহ জেলায় পাখিটির প্রজনন অঞ্চল থাকায় আমাদের দেশের পদ্মায় পাখিটি নিয়মিত দেখা যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে ছয় জাতের মানিকজোড় দেখা যায়। অন্য মানিকজোড়গুলোর মধ্যে এশীয় শামুকখোলের সংখ্যাও বাংলাদেশে বেড়েছে বেশ। কালা মানিকজোড় ও কালাগলা মানিকজোড় অত্যন্ত বিরল পাখি হলেও এখন পদ্মা-যমুনায় প্রতি শীতে দেখা যাচ্ছে। আরেকটি প্রজাতি রাঙা মানিকজোড়। এ দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই শীতে এর দেখা মেলে।