কক্সবাজার থেকে ৮০ কিলোমিটার দক্ষিণে টেকনাফ উপজেলা সদর। সেখানে সেন্ট মার্টিন ঘাট থেকে আপনি বেসরকারি কোম্পানির জাহাজ বা ট্রলার ধরবেন। সাগরপথে দক্ষিণে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা ধরে ৩৮ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে আপনি নামবেন সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পূর্ব দিকের ঘাটে।
ছাউনি দেওয়া ভ্যান অল্প রাস্তার জন্যও বিরাট ভাড়া হাঁকবে। হোটেলে উঠতে যাবেন! গড়পড়তা হোটেলেরও ভাড়া শুনে আঁতকে উঠতে পারেন। ঘর যদিও-বা পেলেন, তেমন সাফসুতরো না। সেবাও ভালো না।
ঘাটে নামার পর থেকে আপনার নাকে লেগে থাকবে একটা বোটকা গন্ধ। লম্বায় ৪ কিলোমিটার আর প্রস্থে ২ কিলোমিটার এই ছোট্ট দ্বীপে যেখানে যাবেন, সব ছাপিয়ে চোখে পড়বে রকমারি আবর্জনা-উচ্ছিষ্ট, রান্নার বর্জ্য, পলিথিন, প্লাস্টিকের বোতল, টিনের ক্যান, আরও কত কী!
এমনকি দূরের সৈকতেও আবর্জনা আর পচা গন্ধ আপনার পিছু ছাড়বে না। দেশের একমাত্র প্রবালসমৃদ্ধ এই দ্বীপে কাক আর কুকুরের ছড়াছড়ি। দ্বীপে মানুষের কর্মকাণ্ড বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাক-কুকুর বাড়ছে। বাড়ছে দূষণ।
ডিমের আকারের এ দ্বীপ হাজার বছরের বেশি পুরোনো। সরকার ১৯৯৯ সালে দ্বীপটিকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে। অর্থাৎ, এ দ্বীপের পানি, মাটি, বায়ু বা প্রাণীর ক্ষতি করে, এমন কোনো কাজ এখানে করা যাবে না। কিন্তু এ দ্বীপে পর্যটন বা লোকবসতির বিস্তার সে কথা মাথায় রাখছে না।
সেন্ট মার্টিনকে বাঁচানোর জন্য পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় গত ডিসেম্বরে একটি আন্তমন্ত্রণালয় সভা করেছিল। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, গত মার্চ থেকে পর্যটক কম যাবে। এবং কেউ রাতে থাকবে না। ক্রমে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে পর্যটকের সংখ্যা বেঁধে দেওয়া হবে। তবে সিদ্ধান্তটি ধোপে টেকেনি। দ্বীপজুড়ে দিনে-রাতে মানুষের বিচরণ চোখে পড়ে।
গত জুনে মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তাঁরা এযাবৎ বেশ কয়েকটি আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক করেছেন। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে ‘দু-এক মাসের মধ্যে’ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে বৈঠক হবে।
গত বছর করা পরিবেশ অধিদপ্তরের সর্বশেষ সমীক্ষাটি বলছে, দ্বীপ এলাকায় ৬৮ প্রজাতির প্রবাল আছে। আরও আছে বহু জাতের কাঁকড়া, শৈবাল, শামুক, ঝিনুক ও কড়ি। আছে ১০০-এর বেশি প্রজাতির পাখি আর পাঁচ প্রজাতির ডলফিন। মাঝেমধ্যে তিমিও দেখা যায়। দ্বীপঘেরা নারকেলগাছে, যা থেকে এর স্থানীয় নাম নারিকেল জিঞ্জিরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান সেন্ট মার্টিনের জীববৈচিত্র্য নিয়ে একটি গবেষণা করছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে এখন শুধু এ দ্বীপে ধূসর বক আর জীবন্ত প্রবাল টিকে আছে। তা-ও জীবন্ত প্রবাল আছে শুধু দক্ষিণের ছেঁড়া দ্বীপ অংশে।
>অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন ও দূষণের কারণে প্রবাল, বিরল প্রজাতির কচ্ছপসহ প্রাণীরা বিপন্ন
ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে গেছে
অধ্যাপক মনিরুল বলেন, যেটুকু প্রাণসম্পদ টিকে আছে, তা এখন বিপন্ন। কারণ, অপরিকল্পিত পর্যটন। ঘন ঘন জাহাজ আসায় প্রবাল উপদ্রুত হচ্ছে। প্রবালপ্রাচীরের স্তরে স্তরে পলিথিন-প্লাস্টিকসহ নানা দূষিত পদার্থ জমা হচ্ছে। প্রবাল মরছে। ইদানীং সাইকেল আর মোটরসাইকেলে ঘোরাঘুরি বাড়ায় পর্যটকেরা প্রান্তিক এলাকাগুলোতেও দূষণ নিয়ে যাচ্ছেন।
গত মে মাসে সাগর উত্তাল থাকায় যাওয়া হয়নি, সেন্ট মার্টিনে শেষ যেতে পেরেছিলাম গত ডিসেম্বরে। সেন্ট মার্টিনের ছেঁড়া দ্বীপের সৈকতের কাছেই ইতস্তত ছড়ানো অল্প কিছু জীবন্ত প্রবাল দেখেছিলাম। আশপাশের বেশ কয়েকজন প্রবীণ বলেছিলেন, দ্বীপটি প্রায় প্রবালশূন্য হয়ে পড়েছে। অধিদপ্তরের সমীক্ষা বলছে, শীতকালে কোনো কোনো দিন ৮ থেকে ১০টি জাহাজ বোঝাই করে পর্যটকেরা দ্বীপে যান।
অধ্যাপক মনিরুল আরও বলছেন, জেটির এলাকাগুলো সামুদ্রিক কাছিমের ডিম পাড়ার জায়গা ছিল। এখন কাছিম এদিক-সেদিক যা-ও বা ডিম পাড়ে, কুকুরের পাল তা খেয়ে ফেলে। পরিবেশ অধিদপ্তরের সমীক্ষা অনুযায়ী, মানুষও ডিম তুলে নেয়। হোটেলের আলো কচ্ছপদের বিরক্ত করে। ফলে কচ্ছপ আর আগের মতো আসে না।
একটি আন্তর্জাতিক সাময়িকীর ২০১৬ সালের জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত গবেষণাপত্র বলছে, সেন্ট মার্টিনে ১৯৮০ সালে ১৪১ প্রজাতির প্রবাল ছিল। দ্বীপসংলগ্ন প্রবালের ওপর পরিবেশের প্রভাব নিয়ে বাংলাদেশের চারজন গবেষকের করা ওই গবেষণা বলছে, ২০১৬ সালে তা ৪১টিতে নেমে এসেছে। সুরক্ষার উদ্যোগ না নিলে ২০৪৫ সালের মধ্যে দ্বীপটি প্রবালশূন্যও হয়ে যেতে পারে। ঝুঁকির মূল কারণ হচ্ছে প্রবাল সংগ্রহ এবং অতিরিক্ত মাছ ধরা। এ ছাড়া সামনে প্রবাল আহরণ থেকেও ঝুঁকি আসতে পারে।
হোটেলগুলোর সীমানাপ্রাচীর বা উঠানে প্রবালের বড় বড় টুকরা বসানো দেখা যায়। দ্বীপবাসীর একটি প্রধান জীবিকা হচ্ছে মাছ ধরা। বিশ্বজুড়ে প্রায় বিপন্ন দুই প্রজাতির কচ্ছপ বাস করে এই দ্বীপে। জেলেদের জালে কচ্ছপ ধরা পড়ছে। দ্বীপে সুপেয় পানির অভাব প্রকট। সেটা মেটাতে গিয়ে আরেক বিপদ ডেকে আনছে মানুষ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ওই দ্বীপে ভূগর্ভস্থ পানির উৎস নেই। বৃষ্টির পানি চুয়ে মাটির নিচে জমে। পরিবেশ অধিদপ্তরের গত বছরের সমীক্ষাটি দেখেছে, পর্যটক ও দ্বীপবাসীদের চাহিদা মেটাতে দ্বীপের ভূগর্ভে থাকা পানি ফুরিয়ে যাচ্ছে। ফাঁকফোকরে লোনাপানি ঢুকে পড়তে পারে।
আন্তর্জাতিক সাময়িকীটির সমীক্ষা অনুযায়ী, সৈকতসংলগ্ন এলাকায় শতাধিক অবৈধ হোটেল-মোটেল হয়েছে। দ্বীপজুড়ে ছোট ছোট রেস্তোরাঁ হয়েছে। রান্নার ও অন্যান্য বর্জ্য দ্বীপে ও সাগরে ফেলা হয়। দ্বীপবাসী আর পর্যটকদের মলমূত্র ও অন্যান্য বর্জ্যের কারণে দ্বীপটির পানিতে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের চেয়ে ১০ গুণ বেশি জীবাণু পাওয়া গেছে।
২০১৬ সালে দ্বীপে প্রায় ৯০০ পরিবার বসবাস করত। গবেষণাটি বলছে, মাত্র ৫ শতাংশের বাড়িতে স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার ছিল। গত ডিসেম্বরে কক্সবাজারকেন্দ্রিক সংগঠন ইয়ুথ এনভায়রনমেন্টাল সোসাইটি (ইয়েস) সেন্ট মার্টিনের অবৈধ হোটেল-মোটেলের একটি তালিকা করে। তখন এগুলোর সংখ্যা ছিল ১০৬, আরও অনেকগুলো তৈরি হচ্ছিল।
ইয়েসের তথ্য অনুযায়ী, হোটেল-মোটেলের প্রায় সবই ২০০৭ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে নির্মিত হয়েছে। কোনোটিরই নিজস্ব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই। পর্যটকদের মলমূত্র, উচ্ছিষ্ট, পানির বোতল—এসব দ্বীপের যত্রতত্র ফেলা হচ্ছে। এভাবে দ্বীপটি আস্তে আস্তে একটি ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সমীক্ষাটি বলছে, হোটেল-মোটেলের রান্নার জ্বালানির জন্য দেদার গাছ কাটা হচ্ছে। দ্বীপে বিদ্যুৎ নেই। হোটেল-মোটেলগুলো সব সময় জেনারেটর চালায়। বিকট শব্দ আর ধোঁয়া প্রাণীদের জন্য ঝুঁকি। পর্যটকদের খাওয়াতে নিয়মিত কাঁকড়া ধরা হয়।
হোটেল-মোটেলসহ অনেকগুলো স্থাপনা অবৈধ। এগুলো প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এ এলাকার জন্য প্রযোজ্য বিধিনিষেধ অমান্য করে করা হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর কয়েক দফায় এখানকার ১১টি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ১ কোটি ৮১ লাখ টাকা জরিমানা করেছিল। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নোটিশও দিয়েছে।
বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী প্রথম আলোকে বলেন, এখানে যাঁরা হোটেল-মোটেলগুলো চালান, পরিবেশবান্ধব পর্যটনসেবা সম্পর্কে তাঁদের কোনো ধারণা নেই। তাঁরা বরং পরিবেশ ধ্বংস করছেন। সরকার এগুলো উচ্ছেদ করে একটি নির্দিষ্ট স্থানে পর্যটনের সুযোগ রাখতে চায়।
এর আগে ২০০৯ সালেও বেশ কিছু স্থাপনা উচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। তবে ওই প্রক্রিয়ায় যুক্ত অধিদপ্তরের উচ্চপর্যায়ের সূত্র প্রথম আলোকে বলেছে, সেটা পরে থেমে যায়। জীববৈচিত্র্য ও বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ রেজা খান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি এতগুলো সংস্থা থাকতে কীভাবে ওই দ্বীপে এতগুলো অবৈধ অবকাঠামো হলো, তা বোধগম্য নয়।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, হোটেল-মোটেলগুলো নির্মাণের সময় সরকারের তরফ থেকে কেউ কোনো বাধা দেয়নি, বরং টেকনাফ উপজেলার প্রশাসনিক দপ্তরের সামনে দিয়ে নির্মাণসামগ্রী দ্বীপে এসেছে। স্থানীয় পরিবেশ আন্দোলনকর্মীরা তখন এর প্রতিবাদে রাজপথে নেমেছিলেন। ফজলুল কাদের বলেন, তাঁরা বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রীসহ কর্তাব্যক্তিদের বলেছেন যে সেন্ট মার্টিন এখন মুমূর্ষু।
গত ডিসেম্বরের আন্তমন্ত্রণালয় সভার কার্যপত্রে বলা হয়েছে, সরকারি সংস্থা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর দ্বীপের ভেতর যত পাকা রাস্তা তৈরি করছে, তত স্থাপনা তৈরি বাড়ছে। কার্যপত্রে আরও কিছু সমস্যার কথা আছে। যেমন, সৈকতের বাদাবন (ম্যানগ্রোভ) ও কেয়াবন ধ্বংস করায় এবং পাথর তুলে নেওয়ায় সৈকত ভেঙে দ্বীপ ছোট হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া দ্বীপের জেটি থেকে ছেঁড়া দ্বীপে অবৈধভাবে স্পিডবোটে যাতায়াত চলছে।
ওই সভায় পরিবেশ অধিদপ্তর সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে বাঁচাতে জরুরি, স্বল্প ও মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি অনেকগুলো সুপারিশ করেছে। জরুরি পদক্ষেপের মধ্যে আছে ছেঁড়া দ্বীপে পর্যটক যাওয়া একেবারে নিষিদ্ধ করা। এ ছাড়া দিনে দুটির বেশি জাহাজ চলাচল, প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলা এবং সাইকেল-মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ করতে হবে। দ্বীপে আর জমি কেনাবেচা বা রাস্তা বানানো যাবে না। সেখানে সব ধরনের নির্মাণকাজ বন্ধ করে সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হবে।
সুপারিশমালায় আরও আছে, পর্যায়ক্রমে দ্বীপের সব বর্জ্য একটি কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসতে হবে। কমপক্ষে ৩ বছরের জন্য পর্যটক যাওয়া নিষিদ্ধ করে তারপর শুধু দিনের বেলায় পর্যটন চালু রাখা যায়। ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে সরকারকে হোটেল-মোটেলের সব জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। এসব যদি করা যায়, তাহলেই হয়তো অনন্য এই দ্বীপ ঘিরে প্রবাল বাড়বে, দ্বীপ বড় হবে, বিরল প্রাণীরা রক্ষা পাবে। পরিবেশ অধিদপ্তরের অন্তত দুজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, এগুলো নিয়ে কোনো কাজই হয়নি।
অনন্য এ দ্বীপকে বাঁচাতে ব্যবস্থা নিন
আইনুন নিশাত
আমি দীর্ঘদিন ধরে সেন্ট মার্টিন দ্বীপটি পর্যবেক্ষণ করছি। আমি যখন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) এ-দেশীয় পরিচালক ছিলাম, তখন দ্বীপটি নিয়ে একটি গবেষণা করিয়েছিলাম। তখন প্রথম প্রমাণ পাওয়া যায়, এটা প্রবাল দিয়ে গঠিত নয়। এটা আসলে একটি পাথুরে দ্বীপ।
এটা মহেশখালী দ্বীপের একটি সম্প্রসারিত অংশ। তবে এর মধ্যে বিপুল পরিমাণ প্রবাল ও সামুদ্রিক ঘাস এসে জমা হয়েছে। পৃথিবীর খুব কম দ্বীপে এ ধরনের বৈশিষ্ট্য আছে। যেখানে সামুদ্রিক ঘাস ঘন, সেখানে নানা ধরনের সামুদ্রিক মাছ থাকছে। নানা ধরনের রঙিন মাছ ও ঘোড়ামুখো ঘোড়া মাছ এই দ্বীপে আছে।
পর্যটনের জন্য দ্বীপটি খুবই উৎকৃষ্ট। সমুদ্রেরতলদেশে ডাইভ দেওয়ার মতো চিত্তবিনোদনের সুযোগ এখানে আছে। সেন্ট মার্টিনের পর্যটক ধারণের ক্ষমতাকে বিবেচনায় নিয়ে এখানে কোনো পর্যটনের পরিকল্পনা হয়নি। দ্বীপটিতে অনেক আগে থেকে কয়েক হাজার মৎস্যজীবী থাকে। এখন সেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক গিয়ে হাজির হচ্ছে।
পর্যটকেরা রাতে থাকছে। শতাধিক হোটেল-মোটেল রাতে আলো জ্বালাচ্ছে, ভূগর্ভস্থ পানি তুলছে। এই দ্বীপে এগুলো একদম করা উচিত নয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, পানির নিচের দ্বীপভূমি পলিথিন ও প্লাস্টিক দিয়ে ভরে গেছে।
আসলে রাতে পর্যটক একদম নিষিদ্ধ করতে হবে। ভোরে সর্বোচ্চ ৩০০ থেকে ৫০০ পর্যটক যেতে পারবে। তারা দ্বীপটির একটি নির্দিষ্ট স্থানে বেড়িয়ে সন্ধ্যার মধ্যে ফিরে আসবে। প্রশিক্ষিত পথপ্রদর্শক লাগবে। তাঁরা পর্যটকদের বলে দেবেন দ্বীপের কোথায় কী করা যাবে, আর কী করা যাবে না। দ্বীপবাসীকে সরিয়ে কক্সবাজারের অন্যত্র বসত করাতে হবে। এই অনন্য দ্বীপকে বাঁচানোর অন্য কোনো উপায় নেই। পরিবেশ অধিদপ্তরও সরকারকে এই সুপারিশই দিয়েছে।
দ্বীপটিতে মিষ্টি পানির কোনো উৎস নেই। এখানকার উত্তরপাড়া ও মধ্যপাড়ার মাঝখানে একটি জলাভূমি আছে, সেখানে বৃষ্টির পানি জমা হয়। তা চুইয়ে মাটির নিচে কিছুটা যায়। হোটেল-মোটেলগুলো তা দ্রুত তুলে ফেলছে। কিছুদিনের মধ্যে মিষ্টি পানি ফুরিয়ে যাবে। ভূগর্ভস্থ লোনা পানিতে ভরে যাবে। দ্বীপের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়ে যাবে।
সেন্ট মার্টিনের সামুদ্রিক ও জলপাই রঙের কাছিম বিশ্বজুড়ে বিপন্ন ও গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী। বাংলাদেশ এগুলোকে রক্ষার আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। তহবিলও পাচ্ছে। দ্বীপটি সামুদ্রিক কাছিমের ডিম পাড়া এবং তাদের বড় করার সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা। এসব কাছিম যেখানে জন্মায়, প্রজনন বয়সে সেখানেই ফিরে আসে।
কিন্তু পর্যটকদের দূষণ ও আলো তাদের ডিম পাড়তে বাধা দিচ্ছে। দ্বীপের অসংখ্য কুকুর কাছিমের ডিম খেয়ে ফেলছে। কুকুরগুলো সরিয়ে নিতে হবে। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণে চিংড়ি রপ্তানি করে। যেসব দেশ উপকূলীয় কাছিমদের রক্ষা করে না, যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী দেশটি সেসব দেশ থেকে সামুদ্রিক পণ্য নেয় না। কাছিম রক্ষায় বাংলাদেশের অবহেলার প্রমাণ পেলে যুক্তরাষ্ট্র চিংড়ি নেওয়া বন্ধ করে দেবে।
সেন্ট মার্টিনের পশ্চিমে একটি কড়ির স্তূপ ছিল। আমরা শৌখিন পণ্য তৈরির জন্য এ অনন্য সম্পদ প্রায় শেষ করে ফেলেছি। সেন্ট মার্টিন ও হাতিয়া দ্বীপের মাঝখানের অংশটি ইলিশের বেড়ে ওঠার সবচেয়ে বড় স্থান বা নার্সারি গ্রাউন্ড। সেন্ট মার্টিনের দূষণ যেভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে, তাতে ওই স্থানও নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
আদতে আমরা কয়েক বছরের মধ্যে সেন্ট মার্টিনকে পুরোপুরি মেরে ফেলার ব্যবস্থা করছি। দ্বীপটিতে পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হবে। সামান্য কিছু রাজস্বের জন্য মন্ত্রণালয়টি গুরুত্বপূর্ণ এই দ্বীপকে শেষ করে ফেলতে পারে না।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়