জ্বালানি চাহিদা মেটাতে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার শিবিরগুলোতে থাকা রোহিঙ্গারা প্রতিদিন প্রায় ৮০০ টন কাঠ পোড়াচ্ছে। এই কাঠ জোগাড় করতে দুটি ফুটবল মাঠের সমপরিমাণ বনভূমি উজাড় হচ্ছে। এক বছরে ওই কাঠের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় তিন লাখ টন। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্যবিষয়ক সংস্থা (এফএও) এক প্রতিবেদনে এ কথা বলেছে।
রোহিঙ্গাদের জন্য জ্বালানি সরবরাহ করাই এখন সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া সংক্রামক রোগের ঝুঁকি, অতি ঘনবসতি ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো উন্নয়ন, স্থানীয়দের সঙ্গে বিরোধকে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন সরকারি কর্মকর্তারা। বর্ষাকালে পাহাড়ধসের আশঙ্কাও আছে। দুর্ঘটনা এড়াতে এখনই প্রস্তুতি নিচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
খুব সহজে ও শিগগির রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করা সম্ভব হবে বলে মাঠপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা মনে করেন না। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘হঠাৎ করে আসা বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে আমরা সফলভাবে আশ্রয় দিতে পেরেছি। তাদের বসবাসের স্থান হয়েছে। নিয়মিত খাদ্যের সংস্থান আছে। চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। শিবিরগুলোতে শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। এখন প্রত্যাবাসনের অপেক্ষা।’ তিনি আরও বলেন, প্রত্যাবাসন না হওয়া পর্যন্ত বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে সরকারকে। এর মধ্যে জ্বালানি সমস্যাই প্রধান। সমস্যা আরও আছে।
সর্বশেষ তথ্য অনুয়ায়ী, গত ২৫ আগস্টের পরে ৬ লাখ ৭২ হাজার ৯৫০ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে। এদের টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলার বনভূমিতে গড়ে তোলা শিবিরে রাখা হয়েছে। আগেও বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ছিল। সব মিলে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশে। এখনো রোহিঙ্গারা আসছে।
জ্বালানি সমস্যা
পুরোনো রোহিঙ্গারা রেশন হিসেবে জ্বালানি সহায়তা পায়। ২৫ আগস্টের পর আসা রোহিঙ্গারা তা পায় না। প্রতিদিনের রান্নার জন্য তারা কাঠ কিনছে। এই কাঠের উৎস স্থানীয় বন। সম্প্রতি ছয়টি রোহিঙ্গা শিবিরে কাঠ বিক্রি হতে দেখা গেছে। কুতুপালং শিবিরে কাঠের স্থায়ী বড় বড় দোকান আছে। এ ছাড়া শিবিরগুলোর সামনে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের পাশে অনেকে কাঠের বোঝা নিয়ে বসে থাকেন। শিবির থেকে রোহিঙ্গারা এসে কাঠ কিনে নিয়ে যায়।
বালুখালী ২/২ শিবিরের মমতাজ বেগম বলেন, তাঁর আট সদস্যের পরিবার। তাঁরা শিবিরের সামনে সড়ক থেকে কাঠ কেনেন। আবার তাঁর কিশোর ছেলে পাশের বন থেকে শুকনা কাঠও সংগ্রহ করে আনে নিয়মিত।
কক্সবাজারে বনভূমি ধ্বংস নিয়ে এফএও জরিপ করে গত বছরের সেপ্টেম্বরে। তাতে দেখা যায়, প্রতিদিন ৮০০ টন করে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে শিবিরগুলোতে। বন বিভাগ নিজেও বনভূমি ধ্বংস নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করছে। চলতি মাসে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ পর্যন্ত ধ্বংস হওয়া বনভূমির আর্থিক মূল্য প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। রোহিঙ্গা শিবির করতে গিয়ে ৪ হাজার ১৪০ একর বনভূমি শেষ হয়ে গেছে।
এ ছাড়া পাহাড়ের গাছ কেটে রোহিঙ্গা শিবির গড়ে তোলা হয়েছে। এলাকায় গেলে একেবারে ন্যাড়া পাহাড়ও চোখে পড়ে। এসব পাহাড়ের মাটি আলগা হয়ে গেছে। আগামী বর্ষা মৌসুমে এসব এলাকায় পাহাড়ধসের আশঙ্কা করছেন অনেকেই।
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আলী কবির প্রথম আলোকে বলেন, নতুন রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে। এই কাঠ অন্য কোনো জেলা থেকে আসছে না। আসছে কক্সবাজারের বনাঞ্চল থেকে। তিনি বলেন, প্রতি পরিবারে দৈনিক কমপক্ষে পাঁচ কেজি জ্বালানি কাঠের দরকার হয়। ১ লাখ ৫০ হাজার পরিবারের জন্য দৈনিক যে পরিমাণ কাঠ দরকার হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ওই পরিমাণ কাঠের জন্য দুটি ফুটবল মাঠের সমান বনভূমির দরকার হয়।
সংক্রমণের ঝুঁকি
রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে ডিফথেরিয়ার প্রকোপ ও মৃত্যুর ঘটনার পর ভবিষ্যতে আরও নতুন কোনো রোগের আশঙ্কায় আছে সরকার, বিশেষ করে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দিল্লি থেকে আসা কর্মকর্তা নীলেশ বুদ্ধ প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গাদের পুষ্টি পরিস্থিতি খুবই খারাপ। রোগপ্রতিরোধে তাদের কোনো টিকা দেওয়া হয়নি। রোহিঙ্গাদের মধ্যে ডিফথেরিয়ার প্রকোপ তার বড় উদাহরণ।
৮ নভেম্বর সীমান্তবিহীন চিকিৎসকদের একটি চিকিৎসা কেন্দ্রে প্রথম ডিফথেরিয়া রোগী চিহ্নিত হয়। এরপর দ্রুত এই রোগ রোহিঙ্গাদের মধ্যে ছড়াতে থাকে। এ পর্যন্ত প্রায় চার হাজার মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছে ৩০ জন। কিন্তু স্থানীয় মানুষের মধ্যে এই রোগ দেখা দেওয়ার পর স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে যায়। এ পর্যন্ত ২২ জন স্থানীয় শিশু এতে আক্রান্ত হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রথমে হাম ও এইডস ধরা পড়ে। সরকার রোহিঙ্গাদের হামের টিকা দেয়। এরপর কলেরা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় নয় লাখ কলেরার টিকা দেওয়া হয়। ডিপথেরিয়া দেখা দেওয়ার পর ১৫ বছরের কম বয়সী সাড়ে তিন লাখ শিশুকে ডিফথেরিয়ার প্রথম দফা টিকা দেওয়া হয়েছে। ২৫ জানুয়ারি থেকে দ্বিতীয় দফা টিকার প্রস্তুতি চলছে। তার আগে পোলিও, জন্ডিস, ধনুষ্টঙ্কার, হুপিংকাশির টিকাও দেওয়া হয়। এ ছাড়া রোহিঙ্গা শিশুদের ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুলও খাওয়ানো হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আশঙ্কা করছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে রোটা ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। এই ভাইরাসের কারণে একধরনের ডায়রিয়া হয়। কক্সবাজার জেলার সিভিল সার্জন মো. আবদুস সালাম বলেন, ‘রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে রোটা ভাইরাসের টিকা দেওয়ার কথা সক্রিয়ভাবে চিন্তা করা হচ্ছে।’
ঘনবসতি
সাড়ে চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা এখন কুতুপালং ও কুতুপালং-বালুখালি বর্ধিত শিবিরে বাস করছে। অত্যন্ত ঘন বসতিকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন কর্মকর্তারা। নতুন আসা রোহিঙ্গারা শরণার্থীর স্বীকৃতি না পাওয়ায় বিভিন্ন শিবিরে তাদের ঘরগুলো মানসম্পন্ন নয়। দ্রুতই তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অনেক ঘর সামান্য ঝড়ে পড়ে যাবে বলে সরকারি কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন। একটি এলাকায় বহু মানুষের কারণে হঠাৎ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও অবনতি হচ্ছে। তবে এর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
ইতিমধ্যে শিবিরগুলোকে ২০টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি ব্লককে পৃথক প্রশাসনিক ব্যবস্থার আওতায় আনা হচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রশাসনিক অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ১১ জন জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিবকে পদায়ন করেছে সরকার।
ক্ষোভ ও বঞ্চনা বাড়ছে
রোহিঙ্গারা টেকনাফ ও উখিয়ায় স্থানীয়দের সংখ্যালঘুতে পরিণত করেছে। এই দুই উপজেলার জনসংখ্যা ৪ লাখ ৭২ হাজার। আর রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ১০ লাখের বেশি।
সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয় স্বাস্থ্যে ও শিক্ষায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে। হাসপাতালে রোগীর চাপ বেড়েছে।
রোহিঙ্গারা শ্রমবাজারে ঢোকার কারণে স্থানীয় দিনমজুরদের উপার্জন কমেছে। স্থানীয়ভাবে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে। এসব কারণে রোহিঙ্গাদের ওপর দিন দিন স্থানীয় মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে। পাশাপাশি স্থানীয় মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতাও কাজ করছে। বড় বড় রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর পাশে স্থানীয় বাঙালিদের ছোট ছোট পাড়া বা বাড়ি। ইতিমধ্যে একাধিক ছোট ছোট বিরোধ ও মারপিটের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনা আরও বাড়তে পারে বলে সরকারি কর্মকর্তারা মনে করছেন।